রুস্তম আলী বাবার চিঠির উত্তর দেয় না। সালমার মাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার মধ্যে কোনোরকম আগ্রহ দেখা যায় না। বর্তমানে সে একটি সুররিয়েলিস্টিক উপন্যাস লেখার চিন্তায় ব্যস্ত আছে। উপন্যাসের নায়ক মৃত। কিন্তু সে তা জানে না। সে তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করে। তার ছেলেকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যায়। পিজাহাটে নিয়ে যায়। ছেলে পিজা খায়, সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। নিজে কিছু খায় না। কারণ সে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। নায়ক হিন্দু, নাম শলারাম। শলারাম শব্দটা উল্টালে হয় মরা লাশ।
অতি জটিল উপন্যাস বলেই চিন্তাভাবনাতেই রুস্তম আলীর অনেক সময় কাটছে।
উপন্যাসের নানান খুঁটিনাটি যখনই তার মাথায় আসছে, সে লিখে রাখছে। যেমন, মৃত্যুর এক মাস পরও মানুষের মাথার চুল এবং নখ বাড়ে। বন্ধ হৃৎপিণ্ড হঠাৎ চালু হয়ে কিছু রক্ত সঞ্চালন করে।
রুস্তমের বাড়িভর্তি লোকজন। বেশিরভাগ লোকজনকেই সে চেনে না। একজনের নাম চণ্ডিবাবু। তিনি একতলার সর্বদক্ষিণে থাকেন। দুপুরের পর থেকে বারান্দায় খালি গায়ে বসে থাকেন। তার পরনে থাকে লুঙ্গি। প্রায়ই এই লুঙ্গি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে থাকে বলে বারান্দার দক্ষিণে কেউ তাকায় না।
ড্রাইভার সুরুজকে রুস্তম চেনে। ড্রাইভার সুরুজের সঙ্গে আরেকজন ফিটফাট বাবু থাকে, তাকে সে চেনে না। এই ফিটবাবু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চোখে সানগ্লাস পরে থাকে। ইন করে শার্ট পরে। গলায় লাল রঙের টাই। তার ব্যবহার অত্যন্ত দ্র। যত বারই রুস্তম বের হয়, সে ছুটে এসে গেট খুলে দেয় এবং বিনীত গলায় বলে, স্যার ভালো আছেন? রাতে ঘুম কি ভালো হয়েছে? কোথায় যাচ্ছেন স্যার? গাড়ি বের করতে বলব?
রুস্তম কখনো গাড়ি বের করতে বলে না। তার ক্লস্টোফোবিয়া আছে। গাড়ির দরজা বন্ধ করা মাত্র ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এই গাড়ি নিউমার্কেট থেকে কাঁচাবাজার করার কাজে ব্যবহার হয়।
ইঞ্জিন যেন বসে না যায়, এই জন্য ড্রাইভার সুরুজ সপ্তাহে তিন দিন গ্যারাজে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তখন গাড়ির পেছনের সিটে ফিটবাবু গম্ভীর মুখে বসে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে দাওয়াত খেতে যাচ্ছে।
রান্নাঘরের বাবুর্চি মরিয়মকে রুস্তম চেনে। মরিয়মের সঙ্গে ইদানীং অল্পবয়স্ক সুশ্রী চেহারার এক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। সে সবসময় সেজেগুজে থাকে এবং বিরহী ভঙ্গিতে ঘুরঘুর করে। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে যায়। ছাদে সে গুনগুন করে গান করে। হিন্দি সিরিয়ালের কোনো গান। গানের মাঝখানে হো…হো…হো… শব্দ আছে।
রাত দশটার দিকে সে রুস্তম আলীর ঘরে ঢুকে। তার পরনে থাকে রাতের পাতলা পোশাক। সেই পোশাক এমনই যে তাকালে গা ঝিমঝিম করে। সে রুস্তমের দিকে তাকিয়ে খানিকটা নাকি গলায় বলে, স্যার, কিছু লাগবে?
রুস্তম তখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, না না, কিছু লাগবে না। থ্যাংক ইউ। বিরহিণী তার পরেও দরজা ধরে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। উদাসী এই মেয়ের নাম মুনিয়া। এই নাম কবি রুস্তমের প্রায়ই মনে থাকে না। পাখির নামে মেয়ের নাম, এটুকু শুধু মনে থাকে। কী পাখি সেটা আর মনে আসে না। অদ্ভুত অদ্ভুত পাখির নাম মনে আসে, যেসব পাখির নামে মেয়েদের নাম রাখা হয় না।
যেমন—
ধনেশ পাখি
হরিয়াল
ঘুঘু
লেজবোলা কাকাতুয়া
চিল
সারস
বক
মেয়েটা মনে হয় ড্রাইভারের কোনো আত্মীয় কিংবা ড্রাইভারের সঙ্গে যে ফিটবাবু থাকে তার আত্মীয়। ড্রাইভারকে এবং ফিটবাবুকে মেয়েটা ডাকে ছোটকাকু। রুস্তম প্রায়ই ভাবে, মেয়েটার বিষয়ে খোঁজ নেবে। খোঁজ নেওয়া হয় না।
দোতলায় রুস্তমের আর্ট টিচার সাদেক হোসেন মিয়ার জন্য একটা ঘর আছে। সাদেক হোসেন মিয়া চারুকলা থেকে পাঁচ বছর আগে পাস করেছেন। অনেক চেষ্টা এবং সাধনায় তিনি তার চেহারা উলুমুসের মতো করেছেন। মুখভর্তি দাড়ি। মাথা এবং ভুরু সুন্দর করে কামানো। ডান কানে তিনি দুল পরেন। এই দুলের ডিজাইন তার নিজের। একটা আস্ত পাকা সুপারি রুপার রিংয়ে ঝুলতে থাকে। তার ডিজাইন করা এই দুল এখন অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।
ফ্রান্সে যাওয়ার নানান ধান্ধায় সাদেক হোসেন মিয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তেমন কিছু হচ্ছে না।
সাদেক হোসেন তার ছাত্রকে বলেছেন, আপনার ভেতর জিনিস নাই। জিনিস থাকলে টুথপেস্টের মতো টিপে বের করে ফেলতাম। যাই হোক, আপনার প্রধান কাজ হবে ক্যানভাসে ব্রাশ দিয়ে রঙ ঘষা। রঙ ঘষতে ঘষতে হাত ফ্রি হবে, তখন আমি চেষ্টা নিব।
রুস্তম আলী ক্যানভাসে নিয়মিত রঙ ঘষে যাচ্ছেন। তার শিক্ষক সস্তা সিগারেট ফুঁকে সময় পার করছেন। ভদ্রলোকের থাকা-খাওয়া ফ্রি। মাস শেষে বেতন পাঁচ হাজার টাকা। তিনি বেতনের টাকাটা অতি অনাগ্রহের সঙ্গে হাতে নেন। সেদিনই ছাত্রের ছবি আঁকা বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নেন। কিছু কথাবার্তাও হয়।
রঙ ঘষা চলছে?
চলছে।
কত নম্বর ব্রাশ ব্যবহার করছেন?
ছয়।
সিঙ্গেল রঙ ব্যবহার করছেন তো?
জি।
গুড। এখন শুরু করুন দুটা রঙ ঘষা। ক্যানভাসের এক কোনায় দিবেন কোবাল্ট ব্ল, অন্য কোনায় লেমন ইয়েলো। ডায়াগোনালি রঙ দেওয়া শুরু করবেন। মিডপয়েন্টে দুটা রঙের সাক্ষাৎ হবে। ব্লু এবং ইয়েলো মিলে হবে সবুজ। সবুজের একটা আড়াআড়ি লাইন হবে। লাইন ইউনিফর্ম সবুজ হবে না। গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ এইসব হবে। সেখানেই মজা। বুঝতে পারছেন তো?