উনি একজন মানসিক রোগী। উনার নামের শেষে আছে কৃষ্ণ। শুরুটা তাহলে কি? রাধা? উনার নাম কি রাধাকৃষ্ণ?
রুস্তমের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে। সে খাটে বসে আছে। বাথরুমের দরজা সামান্য খোলা। সেখান থেকে আলো আসছে। মনে হচ্ছে বাথরুমে কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। শুধু যে হাঁটাহাঁটি করছে তা না, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। রুস্তম কথা শোনার জন্য কান পাতল। একটা বাক্যই সে বারবার বলছে–যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে। যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে।…
এই বাক্য আগে কোথাও রুস্তম শুনেছে কিন্তু এখন মনে করতে পারছে। রুস্তম বলল, বাথরুমে কে?
আমি।
আমিটা কে?
ভাই পীর।
এখানে কি?
টয়লেট করতে এসেছি।
রুস্তম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। পুরোটাই বিভ্রম। ডাক্তার রেণুবালাকে নতুন বিভ্রমের কথাটা বলতে হবে।
রুস্তমের মায়ের তালাবদ্ধ ঘর
রুস্তমের মায়ের তালাবদ্ধ ঘর অনেক দিন পর খোলা হয়েছে। ঝাড়গোছ করা হচ্ছে। ঘরের দরজা-জানালা সবই বন্ধ ছিল, তারপরও এত ধুলা জমল কিভাবে কে বলবে! বদ্ধঘরে বাসি খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়, এই ঘরে ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ। এই গন্ধ আসছে বন্ধ আলমারি থেকে। রুস্তমের মা আসমা কাপড়ে প্রচুর ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। এই গন্ধের প্রতি তার দুর্বলতাও ছিল। প্রায়ই দেখা যেত, হাতভর্তি ন্যাপথলিন নিয়ে আসমা বসে আছেন। মাঝে মাঝে শুকছেন।
ঘর পরিষ্কার করা হচ্ছে আমিনের উপস্থিতিতে। এই কাজের জন্য তিনি তার নিজের লোক নিয়ে এসেছেন। নাকে রুমাল চেপে আমিন বসে আছেন। একে একে নির্দেশ জারি হচ্ছে। নাক-মুখ রুমালে বন্ধ বলে তার নির্দেশ কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।
পুরো ঘর সিলিংসুদ্ধ পরিষ্কার করবে। তারপর ভিক্সল দিয়ে মেঝে মুছবে। ফাইনাল স্টেজে স্যাভলন মেশানো পানি ব্যবহার করবে। গাবদা খাটটা সরাও, আমি সিঙ্গেল খাট রাখব। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সব ক্লিয়ার। ঘরের মধ্যে খোলামেলা ভাব আমার পছন্দ। এই সিলিং ফ্যান, থাকবে না। নতুন সিলিং ফ্যান বসবে। মিস্ত্রি খবর দিয়েছি। মিস্ত্রি এসে এসি লাগাবে। সন্ধ্যার মধ্যে কাজ কমপ্লিট হতে হবে। সাতটায় আমি এই ঘরে উঠব। দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে দাখিল হবো। যা বলেছি অল ক্লিয়ার?
কেউ জবাব দিল না। সবাই নিজের মতো কাজ করছে। রুস্তম এসে বলল, দুলাভাই আপনি ধুলাবালির মধ্যে বসে আছেন কেন?
আমিন বললেন, কাজ দেখছি। কাজ দেখতে আমার ভালো লাগে।
চা-কফি কিছু খাবেন?
ফার্স্ট ফেজ ক্লিনিংয়ের পর চা খাব। ধুলা একটু কমুক। তোমার বাড়িতে নানান অপরিচিত লোকজন দেখছি। এরা কারা?
ঠিক জানি না এরা কারা।
একজনকে দেখলাম হাফ নেংটা হয়ে বারান্দায় বসা। এ কে?
উনার নাম চণ্ডিবাবু। উনি কে জানি না।
অদ্ভুত কথা শুনলাম। তোমার বাড়িতে বাস করে আর তুমি জানো না এ কে? মুনিয়া মেয়েটাকে দেখলাম ঘুরঘুর করছে, সে এখানে কেন?
মুনিয়াকে চিনেন?
ফাজিল মেয়ে। চিনব না কেন? আরোগ্য ক্লিনিকের ঝি। তোমার কেবিনে সর্বক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিত। শেষ পর্যন্ত ক্লিনিকের এমডির কাছে কমপ্লেইন করতে হলো। ঝি এখানে কী চায়?
ঝি না দুলাভাই। নার্সের অ্যাসিসট্যান্ট। আমিই তাকে নিয়ে এসেছ।
কেন?
জানি না কেন। ওই সময়ের ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে নেই।
ঝাঁটাপেটা করে ঝি বিদায় করো। তোমার অস্বস্তি লাগলে বিদায়ের কাজ আমি করব। হাতে দুই হাজার টাকা ধরিয়ে রিকশায় উঠিয়ে দিতে হবে।
জি আচ্ছা।
একে বলে ফুড ফর ওয়ার্ক। তোমার এখানে থাকব-খাব, বিনিময়ে কিছু কাজ করে দেব না? নিচে আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলো। হানড্রেড পারসেন্ট ইংলিশ সাহেব। গলায় টাই, চকচকে জুতা। আমি বললাম, নাম কী? নাম বলল, ইমন আহমেদ। আমি বললাম, আপনি করেন কী? সে বলল, চাকরির সন্ধানে আছি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভু দিচ্ছি। আমি বললাম, চাকরির সন্ধানে আছ ভালো কথা। এখানে কেন? সে বলল, স্যার আমাকে এ বাড়িতে থেকে চাকরি খুঁজতে বলেছেন। চাকরি পেলে চলে যাব। রুস্তম তুমি কি তাই বলেছ?
বলতে পারি। মনে হয় আমার অসুখের সময় ঘটনা ঘটেছে। অসুখের সময়ের অনেক কথা আমার মনে নেই।
আমিন বললেন, সাত দিন সময়। সাত দিনের মাথায় তাকে চলে যেতে হবে। আমিই ব্যবস্থা করব। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু দেখবে। তুমি অবজারভার। আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব আমার। আমি মর্জিনা।
মর্জিনা কে?
আলি বাবা চল্লিশ চোরের মর্জিনা। সে ঘর ঝাঁট দিত আর কোমর দুলিয়ে গান করত, ছিঃ ছিঃ ঘরমে এত্তা জঞ্জাল।
ও আচ্ছা।
পাশের ঘরে একজনের সঙ্গে দেখা হলো। শুনলাম সে নাকি তোমার আর্ট টিচার।
জি, হোসেন মিয়া। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। রাষ্ট্রপতি গোল্ড মেডেল পাওয়া।
তার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, ঘর অন্ধকার করে খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। হাতে কোকের গ্লাস। আমি বললাম, কী খাচ্ছেন? সে বলল, রাম খাচ্ছি।
আমি বললাম, রাম জিনিসটা কী?
সে বলল, এক ধরনের অ্যালকোহল। মোলাসিস বা চিটাগুড় থেকে তৈরি হয়। খেতে মিষ্টি। এমনভাবে বলল, যেন দিনে-দুপুরে মদ খাওয়া কোনো ব্যাপারই না। একেও বের করে দিতে হবে, তবে অন্যরা যেমন নরম্যালি বের হবে সে সেভাবে বের হবে না। একে কানে ধরে বের করে দিতে হবে। কত বড় সাহস, দিনে-দুপুরে এম খায়! দুদিন পর লক্ষ্মণ খাবে, ভারত খাবে, সীতা খাবে। বদমাইশ।
রুস্তম বলল, তার সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না দুলাভাই। উনি আমার টিচার।