জি। কী সর্বনাশ! বলেই মুনিয়া লাফ দিয়ে সরল।
সাপ যে ফণা তুলেছে দেখেছ?
জি।
সাপের মাথা কোনটা, লেজ কোনটা?
মুনিয়া ইতস্তত করে বলল, এইটা মাথা।
রুস্তম বলল, তুমি সাপ দেখছ না। লাঠিই দেখছ। সাপ বললে আমি খুশি হবো ভেবে বলেছ সাপ। তুমি লাঠি দেখছ না?
জি।
লাঠিটা তুলে তোমার ঘরে নিয়ে রাখো। আমার ডাক্তার বলেছে লাঠি সঙ্গে না রাখতে। গোলাম মওলা আংকেল এলে তাকে লাঠিটা ফেরত দিতে হবে।
আজ রাতে আপনার ঘরে ঘুমাব না?
না। এখন তো আর আমার ভয় করছে না। সাপ নিয়ে তুমি চলেই যাচ্ছ।
রাত-বিরাতের কথা। অন্য কিছু দেখেও তো ভয় পেতে পারেন। আমি ঝিম ধরে শুয়ে থাকব। ওই রাতের মতো কটকট করে কথা বলব না।
কোনো প্রয়োজন নেই। আজ ঠিক করেছি অনেক রাত পর্যন্ত লেখালেখি করব। ভালো কথা, তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই। তোমাকে এই বাড়িতে কে এনেছে?
আপনি এনেছেন।
আমি এনেছি?
জি।
আমি তোমাকে কোথায় পাব যে এ বাড়িতে নিয়ে আসব?
স্যার! রেগে যাচ্ছেন কেন?
রেগে যাচ্ছি না, প্রশ্ন করছি।
আপনার একবার শরীর খুব বেশি খারাপ করল। আপনি কাউকেই চিনতে পারেন না। তখন আপনি কিছুদিন আরোগ্য ক্লিনিকে ছিলেন।
রুস্তম বলল, এটা মনে আছে।
আমি ওই ক্লিনিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স।
অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স কী জিনিস?
নার্সরা তো অনেক কিছু জানে। আমি কিছু জানি না। বিছানার চাদর বদলে দেই, রোগীদের গা স্পঞ্জ করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, এখানে কাজ করতে আমার ভালো লাগে না। আপনি আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিন। আপনি বলেছিলেন, আচ্ছা। তারপর আমি নিজে নিজে চলে এসেছি।
কাঁদছ কেন?
আপনি আমাকে চিনতে পারেন নাই, এ জন্য কাঁদছি।
মুনিয়া এখন যাও, আমি আমার উপন্যাসটা নিয়ে বসব।
স্যার, আপনি আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। আরেকবার যদি মুনিয়া ডাকেন তাহলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। চলন্ত ট্রাকের সামনে লাফ দিয়ে পড়ব।
তোমার নাম মুনিয়া, তোমাকে মুনিয়া ডাকতে পারব না?
অন্য সবাই মুনিয়া ডাকবে। আপনি ডাকবেন ময়ূরী।
আচ্ছা ময়ূরী। তুমি এখন যাও। এখনো কেন কাঁদছ?
আপনি কঠিন গলায় যাও বলেছেন, এ জন্য কাঁদছি।
প্লিজ, এখন যাও।
চা-কফি কিছু এনে দেব স্যার?
না।
এক বসাতে উপন্যাস অনেক দূর লেখা হয়ে গেল। রুস্তম রাত একটার কিছু পরে ঘুমুতে এসে দেখে, মুনিয়া মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে আছে। সে বলেছিল, ঘুমানোর সময় তার কাপড় ঠিক থাকে না। এ জন্য ছোটবেলায় সে মায়ের অনেক বকা খেয়েছে। রুস্তম দেখল, ঘটনা সত্যি। আসলেই মুনিয়ার গায়ের কাপড় ঠিক নেই। এই অবস্থায় কত সুন্দর যে লাগছে মেয়েটাকে!
রুস্তম সাবধানে বিছানায় এসে সুইচ বন্ধ করল। মেয়েটার যে অবস্থা! বাতি নেভানো থাকাই ভালো।
স্যার, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
না। এই মাত্র শুয়েছি। তুমি জেগে আছ নাকি?
স্যার, আমি গভীর ঘুমে ছিলাম, খুট করে বাতি নেভালেন সেই শব্দে ঘুম ভেঙেছে।
আচ্ছা ঘুমাও।
কিছুক্ষণ জেগে থাকি স্যার। এই ধরুন পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট আপনার সঙ্গে গল্প করি।
আচ্ছা।
আমার মা, আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস। তাদের কলমাকান্দায় বিশাল ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির নাম দি নিউ মদিনা ফার্মেসি।
ভালো তো।
ছেলেরা দুই ভাই। বড় ভাই দুবাইয়ে চাকরি করেন।
বিয়ে কবে হচ্ছে?
বিয়ে কিভাবে হবে। আমি আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলেছি না।
কাকে বিয়ে করেছ? আমার আর্ট টিচারকে?
উনাকে আমি বিয়ে করব কোন দুঃখে। উনাকে বিয়ে করলে সারাজীবন আমাকে নেংটো করে চেয়ারে বসিয়ে রেখে ছবি আঁকবেন। স্বামীর সামনে উদাম হওয়া যায়। যার-তার সামনে যায় না। ঠিক বলেছি না স্যার?
হুঁ।
মজার ব্যাপার কি জানেন স্যার, আমি যাকে বিয়ে করেছি তিনি নিজেও সেটা জানেন না।
সেটা কি করে সম্ভব?
কাজি ছাড়া বিয়ে বলেই সম্ভব। নতুন ধরনের বিয়ে। এই বিয়েতে কনেকে বরের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে তিনবার বলতে হয় তুমি আমার স্বামী। তুমি আমার স্বামী। তুমি আমার স্বামী। এতেই বিয়ে হয়ে যায়।
এ রকম বিয়ের কথা জানতাম না তো!
আপনার জানার কথাও না। এই ধরনের বিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি।
তোমার আবিষ্কার?
জি। একজনকে খুব বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল, উনাকে বলতে পারছিলাম, তখন বুদ্ধি করে এইভাবে বিয়ে করে ফেলেছি। ভালো করেছি না স্যার?
বুঝতে পারছি না। যাকে বিয়ে করলে সে জানতেও পারল না, এটা কেমন কথা!
আমি জানলাম, আমি মনে শান্তি পেলাম। একজনের মনের শান্তিও তো কম না। স্যার আপনি কি জানতে চান আমি কাকে বিয়ে করেছি?
তোমার গোপন বিষয় আমি জানতে চাচ্ছি না। তারপরেও বলতে চাইলে বলো।
স্যার আমি আপনাকে একটা শিল্লুক দিব। যদি ভাঙাতে পারেন আপনাকে বলব আমি কাকে বিয়ে করেছি। শিল্লুকটা হলো
আমি থাকি জলে
আর তুমি থাকো স্থলে
আমাদের দেখা হবে
মরণের কালে।
শিল্লুকের বিষয়টা ভাবতে ভাবতে রুস্তম গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আজ সে ঘুমের ওষুধ খেতে ভুলে গেছে, তারপরও তার গাঢ় ঘুম হলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল, সে ট্রেনে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। ট্রেনের গতি ক্রমেই বাড়ছে। একসময় ট্রেন লাইন ছেড়ে আকাশে উঠে গেল। ঘুমের মধ্যেই তার মনে হলো, এই স্বপ্নটা লিখে ফেলতে হবে। কারণ, তার ডাক্তার বলে দিয়েছেন অদ্ভুত কোনো স্বপ্ন দেখলেই লিখে ফেলতে হবে। ডাক্তারের নাম রেণুবালা দে। তার চেম্বারে দুজনের ছবি আছে। একজনের নাম স্বামী বিবেকানন্দ। অন্যজনের নাম সে জানে, কিন্তু এখন মনে পড়ছে না।