জনাব, আমার স্ত্রীর মতো বলশালী এবং স্বাস্থ্যবতী মহিলা দুর্লভ। চট্টগ্রামে প্রতি বছর বলীখেলা হয়। মেয়েদের মধ্যে বলীখেলার প্রচলন থাকলে আমার স্ত্রী প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন হতো। এমন একজন কুস্তিগির টাইপ মহিলাকে আমার মতো দুবলা-পাতলা একজন গলা টিপে মারবে এবং সিলিং ফ্যানে দড়ি ঝুলায়ে তাকে ঝুলাবে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? জনাব, আমি আল্লাহপাকের পবিত্র নামে শপথ করে বলছি, ফায়ার ব্রিগেডের ক্রেন ছাড়া ওই মহিলাকে ঝুলানো সম্ভব না। এখন আপনি বলুন আমার পক্ষে কি ফায়ার ব্রিগেড খবর দিয়ে আনা সম্ভব?…
চার পাতার দীর্ঘ চিঠি। চিঠির শেষে মামলা পুনর্বিবেচনার আকুল আবেদন।
আজ মার্চের সতেরো তারিখ। সময় রাত দশটা। আজও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রুস্তম তার উপন্যাস নিয়ে বসেছে। উপন্যাসের প্রথম দুটি লাইন লেখা হয়েছে।
প্রণাশ বাবু নিউমার্কেট কাঁচাবাজার থেকে একটা মাঝারি সাইজের ইলিশ এবং আধা কেজি রাই সরিষা কিনে বাড়ি ফিরলেন। আজ তাঁর সরষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে।
মোবাইল ফোন একটু পরপর বাজছে। রুস্তম টেলিফোন কানে নিয়ে বলল, কে?
আমি।
আমিটা কে? তুই আমার গলা চিনতে পারিস না? আশ্চর্য কথা! আমি সামিনা।
বুবু তুমি কোথায়?
আমি সিঙ্গাপুরে। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে একটা ফুল চেকআপ করিয়ে মালয়েশিয়া বেড়াতে যাব। জাহাজে করে যাব। জাহাজে ক্যাসিনো আছে, অনেক দিন পর জুয়া খেলব।
বুবু, আমি একটা জরুরি কাজ করছি।
আমিও একটা জরুরি কাজেই টেলিফোন করেছি। আজ কত তারিখ জানিস?
না।
আজ মার্চের সতেরো। মায়ের মৃত্যুদিন। আমিও তোর মতো ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম তোকে টেলিফোন করি।
ও আচ্ছা।
আমরা সবাই ভুলে গেলেও তোর দুলাভাইয়ের কিন্তু সবসময় মনে থাকে। ওইদিন সে ফকির খাওয়ায়। মিলাদের আয়োজন করে। এইবার করেছে কি না কে জানে! মনে হয় না করেছে। প্রতিবার এইসব করত আমাকে খুশি করার জন্য। এখন তো আর আমাকে খুশি করার কিছু নাই।
সব বার যখন করে, তখন এইবারও নিশ্চয়ই করবে। মানুষ কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার বাইরে যেতে পারে না।
তুই কি তোর দুলাভাইকে একটা টেলিফোন করে আমাকে জানাবি? আমি টেলিফোন ধরে থাকলাম।
বুবু, দুলাভাইয়ের নাম্বার আমার কাছে নেই। কারও নাম্বারই নেই। কেউ টেলিফোন করলেই শুধু আমি কথা বলি। নিজ থেকে কাউকে টেলিফোন করি না।
আমি নাম্বার বলছি। তুমি কাগজে লেখ।
বুবু, আমি জরুরি কাজ করছি। এখন টেলিফোন করতে পারব না। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে আমি তার কাছ থেকে জেনে রাখব।
রুস্তম টেলিফোন পুরোপুরি বন্ধ করে উপন্যাসে মন দিল আর তখনি কাবার্ডের ভেতর থেকে ফোঁস ফোঁস শব্দ হতে লাগল। রুস্তম চমকে বিছানায় উঠে বসল। এমন কি হতে পারে কাবার্ডের ভেতর লাঠিটা পড়ে গিয়ে সাপ হয়ে গেছে এবং ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে? রুস্তম ডাকল, মুনিয়া! মুনিয়া!
দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই মুনিয়া ঘরে ঢুকল। সে মনে হয় দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল।
স্যার কিছু লাগবে? আরেকটা কথা, আপনি ময়ূরী নাম দিয়ে এখন মুনিয়া ডাকছেন কেন? আমার খুবই মন খারাপ হয়েছে। ময়ূরী ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকলে আমি ঘরে ঢুকব না।
রুস্তম আতঙ্কিত গলায় বলল, কিছু শুনতে পাচ্ছ? মন দিয়ে শোনো।
মুনিয়া বলল, কী শুনতে পাব স্যার?
ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
মুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, পাচ্ছি।
শব্দটা কোত্থেকে আসছে বলতে পারছ?
না।
কাবার্ডের ভেতর থেকে। সেখানে একটা সাপ আছে।
কী সর্বনাশ! সাপ মারার ব্যবস্থা করি?
সাপ মারতে হবে না। এটা সাধারণ কোনো সাপ না। আগে ছিল বেতের লাঠি। এখন সাপ হয়েছে।
ও আচ্ছা।
তারপরেও শব্দটার জন্য ভয় ভয় লাগছে।
মুনিয়া বলল, ভয়ের কিছু নাই স্যার। প্রয়োজনে আমি এই ঘরে ঘুমাব।
তুমি কোথায় ঘুমাবে?
মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে থাকব। আমার অসুবিধা নাই।
বাদ দাও।
বাদ দিব কী জন্য? আপনার শরীর খারাপ, ঘুম প্রয়োজন। সাপের ভয়ে যদি ঘুমাতে না পারেন আপনারই ক্ষতি।
সাপের নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
পরিষ্কার শুনছি। আপনাকে দোষ দিয়া লাভ কী! আমার নিজেরই ভয় ত্ম লাগছে। বিছানা নিয়া চলে আসি?
আসো।
মুনিয়া বিছানা আনেনি, শীতলপাটি এনেছে। খাটের পাশে পাটি পেতেছে। ঘরে বাতি জ্বলছে। মুনিয়া বলল, স্যার! আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ।
কী অনুরোধ?
আপনি আমার দিকে তাকাবেন না। ঘুমের সময় আমার কাপড়চোপড় ঠিক থাকে না। ছোটবেলার বদভ্যাস। এই জন্য মায়ের কাছে কত বকা খেয়েছি।
আমি তাকাব না। এই দেখো চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
চোখ বন্ধ করার দরকার নাই। স্যার একটা গল্প বলেন। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাই।
আমি তো গল্প জানি না।
তাহলে বাদ দেন।
আমি যে উপন্যাস লিখছি সেই গল্পটা বলতে পারি। তবে গল্পটা এখনো তৈরি না।
তৈরি না হলে থাক।
উপন্যাসের নাম দিয়েছি ঝিঁঝি। নামটা কি তোমার কাছে ভালো লাগছে?
অসম্ভব সুন্দর নাম।
ঝিঁঝি পোকার ঝিঁঝি। ঝিঁঝি পোকা হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যে সবসময় ঝিঁঝি শব্দ করে নিজেকে জানান দেয়। মানুষও তাই করে। শুধু মৃত মানুষ নিজেকে জানান দিতে পারে না।
মুনিয়া বলল, আহারে, কী দুঃখের কথা!
ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কারণে রুস্তমের চোখ ভারী হয়ে আসছে। এই অবস্থাতে হঠাৎ তার মনে হলো মুনিয়া মেয়েটি কে? কোন পরিচয়ে এ বাড়িতে থাকছে, তা এখনো জানা হয়নি। জানা দরকার। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই, সকালে জিজ্ঞেস করলেই হবে।