আপনি বললে এখনই যেতে পারি। উনার নাম কী?
নাম কেউ জানে না, সবাই ভাই পীর ডাকে।
ভাই পীরের হুজরাখানা ভর্তি মানুষ। এক মহিলা তিন মাসের সন্তান নিয়ে এসেছেন। সে ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। এক মধ্যবয়স্ককেও কাঁদতে দেখা গেল। তার কাঁধে গামছা। সে কাঁদছে আর গামছায় চোখ মুছছে। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সকাল নয়টার মধ্যে নাম রেজিস্ট্রি করতে হয়। আজকের মতে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে গেছে। আমিন রুস্তমের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঝিম ধরে বসে থাকো। আমি ব্যবস্থা করছি। খাদেমকে টাকা খাওয়ালেই ডাক পড়বে।
রুস্তম বলল, পীর সাহেবের ভিজিট কত?
আমিন বলল, উনি টাকা-পয়সা নেন না। দানবাক্স আছে। দানবাক্সে যার যা ইচ্ছা দেয়।
আমিন কি ব্যবস্থা করলেন বুঝা গেল না তবে দশ মিনিটের মাথায় তাদের ডাক পড়ল।
ভাই পীরের দরবার শরিফ যথেষ্টই আধুনিক। এসি চলছে। ঘর ঠাণ্ড। মেঝেতে টকটকে লাল রঙের কার্পেট। কার্পেটের এক কোনায় ভাই পীর খানিকটা কুঁজো হয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখে চশমা। হাতে সিগারেট। ছাই ফেলার জন্যে দামি অ্যাশট্রে আছে। সব পীর সাহেবদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক খাদেম জাতীয় লোকজন থাকে। ইনার সঙ্গে নেই।
ভাই পীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আপনা দুজন ভালো আছেন? দয়া করে বসুন। বসতে বসতে একটা ফুলের নাম বলুন।
আমিন বললেন, পারুল ফুল।
ভাই পীর হাসতে হাসতে বললেন, পারুলের মাঝের অক্ষর কেটে দিলে হয় পাল। আপনার স্ত্রীর পালে হাওয়া লেগেছে। হাওয়া উঠেছে বলেই হাওয়া লেগেছে। হাওয়া যখন থেমে যাবে তখন পাল চুপসে যাবে।
আমিন বললেন, হাওয়া কখন থামবে?
ভাই পীর বললেন, সেটা আমি বলতে পারব না। আমি আবহাওয়া দপ্তরের কেউ না।
রুস্তম বলল, আমি কি একটা ফুলের নাম বলব?
বলুন।
বকুল।
ভাই পীর হাতের আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, বকুলের মাঝের অক্ষর ফেলে দিলে হয় বল। বল আপনার পায়ে। কিন্তু সবাই ধরে নিয়েছে আপনার পায়ে নেই। এটা একটা আফসোস।
আমিন ভীত গলায় বললেন, আমার স্ত্রী কি ফিরবে?
ভাই পীর বললেন, কনফুসিয়াস বলেছেন, যে বস্তু উপরে উঠে সেই বস্তু একসময় নিচে নেমে আসে। আপনার স্ত্রী যদি উপরে উঠে থাকেন তাহলে নেমে আসবেন।
তাকে নেমে আসার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি?
কিছুই করতে পারেন না। মানুষ জানে না সে নিয়তির সন্তান। সে ভাব করে যে তার Free will আছে। এটা ভেবে সে আনন্দ পায়। একটি পতঙ্গের যেমন ফ্রি উইল বলে কিছু নেই, মানুষেরও নেই।
রুস্তম বলল, আপনি বলছেন সবই নিয়তির খেলা।
আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আমার বলায় কিছু যায় আসে না। রবীন্দ্রনাথের মতো বড় মানুষ বলেছেন মায়ার খেলা। মায়া আর নিয়তি তো একই।
আমিন বললেন, এটা তো একটা নৃত্যনাট্য।
ভাই পীর বললেন, নৃত্যনাট্যের ভেতরে আসল নৃত্য। কবিগুরুর একটা গান কি শুনবেন?
আমিন অবাক হয়ে বললেন, আপনি গান গাইবেন?
ভাই পীর বললেন, আমার গলায় সুর নেই, গান গাইতে পারব না। কবিতার মতো করে বলল–
যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে
তারা কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে।।
একের কথা আরে
বুঝতে নাহি পারে,
বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে॥
যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর
তাদের সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর।
বোঝে কি নাই বোঝে
থাকে না তার খোঁজে
বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে॥
আবৃত্তি শেষ করে ভাই পীর বললেন, কিছু বুঝেছেন?
আমিন বললেন, জি না।
ভাই পীর সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, আপনারা এখন বিদায় হোন। অনেকেই বসে আছে, তাদের সবাইকে কিছু না কিছু বলে ভড়কে দিতে হবে। সবাই এসেছে ভড়কানোর জন্যে।
হুজরাখানা থেকে বের হয়ে আমিন বললেন, বিরাট ভণ্ড। থাবড়ানো দরকার।
রুস্তম বলল, থাবড়ালেন না কেন?
আমিন হতাশ গলায় বললেন, মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সমস্যা। যার করতে ইচ্ছা করে তা করা যায় না।
মার্চ মাসের সতেরো তারিখে
মার্চ মাসের সতেরো তারিখে সাজ্জাদ আলী জেলার সাহেবকে একটি আবেদনপত্র পাঠান। ওই তারিখে তাঁর স্ত্রী খুন হয়েছিলেন। চিঠির বিষয়বস্তু ঘুরেফিরে একই, বিচার পুনর্বিবেচনার আবেদন। একটি আবেদনপত্রের নমুনা–
মাননীয় জেলার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
ঢাকা
জনাব,
আজ আমার জন্য গভীর শোকের একটি দিন। প্রাণাধিক প্রিয় আত্মীয়র মৃত্যুদিবস। এই উপলক্ষে আমি নিজে রোজা আছি। জেলের মসজিদের ইমাম সাহেবকে বলেছি বাদ আসর মিলাদের আয়োজন করার জন্য।
অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, স্ত্রীকে খুনের দায়ে আজ আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। ফাসি হয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু ছিল না। ফাসি হয়ে গেলে আপনাকে আমি আর এই পত্র দেওয়ার সুযোগ পেতাম না। ফাসি হয়ে যাওয়া একদিক থেকে ভালো ছিল। তিলে তিলে মৃত্যু না হয়ে একবারই শেষ।
জনাব, ওই দিনের ঘটনা আপনাকে বলতে চাই। ধানমণ্ডির আমার বাড়িটি দ্বিতল। কাজের মেয়ে, ড্রাইভার, মালী–এদের কারোরই দোতলায় ওঠার হুকুম নাই। ওই রাতে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির রাতে সবাই আরামে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। শুধু সালমার মা এবং তার কন্যা সালমা জাগ্রত। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? জনাবের বাড়িতে নিশ্চয় কাজের বুয়া আছে। জনাব কি লক্ষ করেছেন সুযোগ পেলেই এরা নিদ্রায় চলে যায়।
এখন মূল বিষয় বলি, যেখানে দোতলায় ওঠারই হুকুম নাই, সেখানে গভীর রাতে মাতা-কন্যা দোতলায় আসে কেন? দোতলায় তাদের কী প্রয়োজন, এই কথা কেন কারোর মনে আসে না?