জন্মদিন কেমন হল?
ভালোই। কবিতার বইটির জন্যে ধন্যবাদ। আমি ভাবতেই পারি নি আপনি আমার জন্মদিন কবে সেটা জানেন।
অনেক ঝামেলা করে বের করেছি। গরাজটা যখন আমার।
আপনার গরজ, তার মানে?
মানে কিছু নেই।
ভেবে রাখা কথা কিছুই বলা হয় নি। শারমিন যায় নি পিকনিকে, অথচ এক শ টাকা চাঁদা দিয়েছে। চাঁদা দিয়ে না যাওয়া হচ্ছে একটা বড়লোকী দেখানো। রাগে গা জ্বলে গেছে রফিকের। পিকনিকের সমস্ত আয়োজনটা তার করা। টাকাটা ফেরত দিয়ে অপমান করে দু-একটা কড়া কড়া কথা বলা যায়। খুব ঠাণ্ডা গলায় বলা যেতে পারে, আপনার টাকা আছে জানি। কিন্তু টাকার খেলাটা এভাবে না দেখালেও পারতেন। টাকার খেলা আর যাকে দেখান, দেখান–আমাদের দেখাবেননা।
রফিক ভেবে পেল না, কথাটা ইউনিভার্সিটিতে বললে ভালো হবে, না বাড়িতে গিয়ে বলবে। অনেক ভেবেচিন্তে সে বাড়িতে যাওয়াই ঠিক করল। তো যাচ্ছে না, একটা কাজে যাচ্ছে। ইতস্তত বোধ করার কিছুই নেই।
কিন্তু রফিক ইতস্তত করতে লাগল। গেটের কাছে এসেও মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ফিরে যাওয়াই ভালো। আবার ফিরে যেতেও ইচ্ছা করছে না। এত দূর এসে ফিরে যাবার মানে হয় না।
রহমান সাহেবের মেয়ে বাসায় আছে?
জ্বি, আছেন। যান, কুকুর কিছু করবে না। আপনি সোজা চলে যান। কলিং বেল টিপ দেন।
দারোয়ান তাকে চিনতে পারছে না; তার চেহারা কি এতই সাধারণ যে মাত্র দু সপ্তাহ আগে দেখাও গুবলেট করে ফেলেছে। দারোয়ান একা নয়, কুকুরটা পর্যন্ত তাকে চিনতে পারছে না। অথচ নিম্নশ্রেণীর পশুদের নাকি স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। এক বার কোনো একটি জিনিসের ঘাণ নিলে একটা কুকুর নাকি সারা জীবন সেটা মনে রাখে। এই কুকুরটার সেদিন সর্দি ছিল বোধ হয়। সেদিন যেমন শুকতে শুকতে আসছিল, আজিও তাই আসছে।
গতবার বেল টিপতেই দরজা খুলে দিয়েছিল শারমিন। আজও তাই হবে নাকি?
না, সে-রকম হল না। বয়স্ক এক জন মহিলা দরজা খুলল! কাজের মেয়ে, না আত্মীয়স্বজনদের কেউ? আত্মীয়স্বজনদের কেউ হলে সালাম দেয়া দরকার। রফিক নরম স্বরে বলল, শারমিন আছে?
জ্বি, আছে।
একটু বলেন, রফিক এসেছে।
বসেন। খবর দেই।
রফিক এন্ট্রিরুমে বসে রইল। তারা মনে হতে লাগল।–যেসব কড়া কড়া কথা সে ভেবে রেখেছে সেসব বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না! কারো বাড়িতে এসে অভদ্র হওয়া যায় না। তাছাড়া পিকনিকে না-যাবার তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। অসুখবিসুখ হতে পারে। জরুরী কাজকর্ম থাকতে পারে, না-জেনে হাউ হাউ করা ঠিক না। রফিক বেশ অনেকক্ষণ বসে রইল।
যে-মহিলাটি বসতে বলেছে সে এল না, অল্পবয়েসী একটি মেয়ে এসে বলল, আপামনি বাসায় নাই।
তার মানে?
রফিকের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটি দ্বিতীয় বার বলল, আপামনি বাসায় নাই। রফিক উঠে দাঁড়াল। কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কিছুই মনে আসছে না।
তোমার আপাকে বলবে, মিথ্যা কথা বলবার কোনো দরকার ছিল না। দেখা করবে না বললেই চলে যেতাম।
রফিকের ইচ্ছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাকে হেঁটে হেঁটে গেট পর্যন্ত যেতে হবে। এই বিশাল বাড়ির কম্পাউণ্ড থেকে বেরুতেও সময় লাগবে।
রফিক, তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?
সারাদিন শুয়ে আছে। ব্যাপার কি?
না।
সারাদিন শুয়ে আছ। ব্যাপার কি?
ব্যাপার কিছু না।
আমার তো মনে হয় তোমার জ্বরটির কিছু হয়েছে। চোখ লাল।
তোমার মনে হলেই তো হবে না ভাবী। আমারো মনে হতে হবে। আমার মনে হচ্ছে শরীর ঠিকই আছে।
তুমি উঠে আস, তোমাকে ডাকছেন।
কে ডাকছেন?
কবির মামা। ঘণ্টাখানিক আগে এসেছেন। কী, আসবে না?
কবির মামা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এসেছেন যখন, ইনশাআল্লাহ মাসখানিক থাকবেন। ধীরেসুস্থে আসছি।
রফিক তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল?
কবির মামার বয়স প্রায় ষাট। ছোটখাট মানুষ। থুতনিতে অল্প কিছু দাড়ি আছে; মাথার চুল, দাড়ি-সমস্তটাই ধবধবে সাদা। স্বাস্থ্য বয়সের তুলনায় অনেক ভালো, এবং যতটা-না ভালো, তিনি নিজে মনে করেন তার চেয়েও ভালো–যার জন্যে মাঝে মাঝে গুরুতর ঝামেলার সৃষ্টি হয়।
আজও এ-রকম একটা ঝামেলা বাধিয়েছেন। ছটা ঝুনা নারিকেল নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে কল্যাণপুর পায়ে হেঁটে চলে এসেছেন। এ-রকম একটা কাণ্ড করার পেছনে একমাত্র যুক্তি হচ্ছে, কোনো বাস কণ্ডাকটার নারিকেল হাতে বাসে উঠতে দিতে রাজি হয় নি। এক জন রাজি হয়েছিল, কিন্তু সে নারিকেলের জন্যে আলাদা ভাড়া দাবি করায় কবির মামা রেগে আগুন হয়ে যান এবং হাঁটতে শুরু করেন। কল্যাণপুর এসে পৌঁছতে তার পৌনে চার ঘণ্টা সময় লাগে।
বাসায় ঢুকেই তিনি সোফায় লম্বা হয়ে পড়েছেন। উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। কোমরের একটা পুরানো ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
মনোয়ারা বললেন, পিঠে তেল মালিশ করে দেবো?
দিক। বৌমাকে বল তেল গরম করতে। হোসেন কোথায়?
পেনশনের টাকা তুলতে গেছে। এসে পড়বে।
আসুক, তার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।
চা করে দিক?
চা না। লেবু দিয়ে এক গ্লাস সরবত করে আনতে বল!
নীলু পিঠে তেল মালিশ করতে বসল। কবির মামা ক্ষীণ স্বরে বললেন, মানুষের সেবা। আমি নিই না, লজ্জা লাগে। মা, তোমার সেবা নিতে লজ্জা লাগে না। মনে হয় এই সেবাটাতে আমার অধিকার আছে।
অধিকার তো আছেই।
না গো মা,অধিকার নেই। দুই মাস আগে তোমার একটা মেয়ে হল। আমাকে কেউ একটা খবর দেয় নি। এখানে এসে জানলাম মেয়ে হবার খবর।