- বইয়ের নামঃ ক্রুগো
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. মৃত্যুদণ্ডের আসামী
১. মৃত্যুদণ্ডের আসামী
কিছুদিন আগে আমাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। যে অপরাধের জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ডের মতো বড় শাস্তি দেয়া হয়েছে, সেটিকে আদৌ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় কী না সেটি নিয়ে আমি কারো সাথে তর্ক করতে চাই না। অপরাধ এবং শাস্তি দুই-ই খুব আপেক্ষিক ব্যাপার, রাষ্ট্র যেটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছে, সেটি আমার কাছে নিছক কৌতূহল ছাড়া আর কিছু ছিল না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর থেকে আমার দৈনন্দিন জীবন আশ্চর্য রকম পাল্টে গেছে। বিচার চলাকালীন সময়ে আমার সেলটিকে অসহ্য দমবন্ধ-করা একটি ক্ষুদ্র কুঠুরি বলে মনে হত। আজকাল এই কুঠুরির জন্যেই আমার মনের ভেতর গভীর বেদনাবোধের জন্ম হচ্ছে। ছোট জানালাটি দিয়ে এক বর্গফুট আকাশ দেখা যায়, আমি ঘন্টার পর ঘন্টা সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। নীল আকাশের পটভূমিতে সাদা মেঘের মাঝে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। ইদানীং পৃথিবীর সবকিছুর জন্যে আমার গাঢ় ভালবাসার জন্ম হয়েছে। আমার উচ্ছিষ্ট খাবারে সারিবাঁধা পিপড়েকে দেখে সেদিন আমি তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করেছি।
গত দুই সপ্তাহ থেকে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত করেছি, এটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ। অকারণে জগৎ-সংসারের প্রতি তীব্র অভিমানববাধে যুক্তিতর্ক অর্থহীন হয়ে আসতে চায়। আমার বয়স বেশি নয়, আমি অসাধারণ প্রতিভাবান নই, কিন্তু আমার তীব্র প্রাণশক্তি আমাকে সাফল্যের উচ্চশিখরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনকে উপভোগ, এমন কি অর্থপূর্ণ করার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু আমাকে সে সুযোগ দেয়া হল না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর আমার জীবনের শেষ কয়টি দিনের জন্যে কিছু বাড়তি সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার খাবারে প্রোটিনের অনুপাত বাড়ানো হয়েছে, ভালো পানীয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাথরুমের ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, সর্বোপরি খবরের কাগজ এবং বইপত্র পড়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর কাছাকাছি এসে পৃথিবীর দৈনন্দিন খবরের মতো অর্থহীন ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। আমি প্রথম দিন একার খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে আর দ্বিতীয় বার সেটি খোলার উৎসাহ পাই নি। দূর মহাকাশে একটি মনুষ্যবিহীন স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান পাঠানো-সংক্রান্ত একটি অভিযান নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা ছিল, আমার তাতে কোনো উৎসাহ ছিল না।
মাঝে মাঝে আমি কাগজে আঁকিবুকি করি বা কিছু লিখতে চেষ্টা করি, তার বেশিরভাগই অসংলগ্ন এবং আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন চিন্তা। আমার মৃত্যুর পর হয়তো এগুলো আমার ব্যক্তিগত ফাইলে দীর্ঘকাল অবস্থান করবে। আমি কয়েক বার প্রিয়জনকে চিঠি লেখার কথা ভেবেছি, কিন্তু আমার প্রিয়জন বেশি নেই, যারা আছে তাদের দুঃখবোধকে তীব্রতর করার অনিচ্ছা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছে।
আজকাল আমার সাথে দিনে তিন বার এই সেলটির ভারপ্রাপ্ত রক্ষকের সাথে দেখা হয়, তিন বারই সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসে। আগে সে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করত, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর থেকে খানিকটা সদয় ব্যবহার করা শুরু করেছে। গত রাতে সে নিজের পকেট থেকে আমাকে একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে দিয়েছে, আমি সিগারেট খাই না জেনেও! আমি লোকটিকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ করি, মাঝারি বয়সের সাদাসিধে নির্বোধ লোক, সরকারের নির্দেশিত বাঁধাধরা গণ্ডির বাইরে চিন্তা করতে অক্ষম। ব্যক্তিগত জীবনে এরা সাধারণত সুখী হয়। জীবনের শেষ কয়টা দিন আরেকটু বুদ্ধিমান একটি প্রাণীর সংস্পর্শে থাকতে পারলে মন্দ হত না। আমাকে যেদিন হত্যা করা হবে সেদিন আরো কিছু মানুষের সাথে দেখা হবার কথা। প্রাচীন কালের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে চেয়ারে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হবে। মৃত্যুদণ্ড প্রতিশোধমূলক শাস্তি, এটিকে যতদূর সম্ভব যন্ত্রণাদায়ক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাত থেকে দশ জন মানুষ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে গুলি করে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই যন্ত্রণা খুব অল্প সময়ের জন্যে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে নাকি সারাজীবনের স্মৃতি একসাথে মাথায় উঁকি দিয়ে যায়, আপাতত সেই ব্যাপারটি নিয়ে খানিকটা কৌতূহল ছাড়া আমাকে দেয়ার মতো ভবিষ্যতে কিছু অবশিষ্ট নেই—অন্তত আমি তাই জানতাম।
তাই যেদিন সকালবেলা আমার সেলের দরজা খুলে দু’জন গার্ডসহ একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ লোক আমার সাথে দেখা করতে এল, আমার তখন বিস্ময়ের সীমা ছিল না। লোকটি অত্যন্ত কম কথার মানুষ, আমাকে এবং আমার ক্ষুদ্র অগোছাল ঘরটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল। বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি রাজি থাকলে আপনার মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়মে গুলি না করে অন্যভাবে করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শুধু এটুকু বলার জন্যে আপনি কষ্ট করে এসেছেন?
না।
কী বলবেন বলুন। অপ্রচলিত নিয়মে মারা যাওয়ার জন্যে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আপনি হয়তো জানেন মনুষ্যবিহীন একটা স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান কিছুদিনের মাঝেই মহাকাশে রওনা হচ্ছে।