বেশ কয়েক বার যাওয়া-আসা করেও তার মতলব পরিষ্কার হল না। বরং মনে হল সত্যি সত্যি ইদরিস রফিকের জন্যে কিছু করতে চায়। ব্যাঙ্কলোনের জন্যে ক্লান্তিহীন ছোটাছুটিও সে বেশ আগ্রহ নিয়ে করছে। তার চেয়েও অদ্ভুত কথা, মাতাল অবস্থায় ঐ রাতে সে যা বলেছে, তার কোনটিই দেখা গেল সত্যি নয়। ধারদেন তার একেবারেই নেই। মদ সে সপ্তাহে এক দিনই খায়, তাও নিজের পয়সায় নয়, অন্যদের পয়সায়।
কাঞ্চন বলে একটা মেয়ের অস্তিত্ব অবশ্যি আছে। কলগার্ল ধরনের মেয়ে। ইদরিস তার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে মেয়েটিকে প্রায়ই ক্লায়েন্টের কাছে পাঠায়। কাঞ্চন সেই উপলক্ষে মোটা কমিশন পায়। ব্যাপার এইটুকুই।
রফিক এক দিন বেশ অবাক হয়েই বলল, মাতল অবস্থায় তুই ডাহা মিথ্যা কথাগুলি বললি?
ইদরিস হাসিমুখে বলল, সত্যি কথা বলব আমি? পাগল হয়েছিস? ব্যবসা করে খাই না? সত্যি কথা বললে ভাত জুটবে?
ব্যবসায়ী হলেই সারাক্ষণ মিথ্যা কথা বলতে হবে?
তা তো হবেই। সত্যি কথাগুলিও এমনভাবে বলতে হবে, যাতে শুনলে মনে হবে মিথ্যা। হা হা হা। তারপর যখন ব্যবসা ফুলেফেপে বিশাল হয়ে যাবে, তখন কথাবার্তা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। তখন কথা বলবে ভাড়া-করা লোক। বুঝতে পারছিস?
এখনও পারছি না, তবে চেষ্টা করছি।
বিরাট ব্যবসায়ীরা দেখবি ব্যবসা নিয়ে একেবারেই কথাবার্তা বলে না। তারা কথাবার্তা বলে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে।
তাই নাকি?
তোকে এক দিন এ-রকম এক জনের কাছে নিয়ে যাব। বিড়ির বিজনেস করে লাল হয়ে গেছে। এখন রবীন্দ্রচর্চা করে। বিরাট এক প্রবন্ধও লিখেছে–রবীন্দ্রকাব্যে মুসলমানি শব্দ।
প্রশ্ন হয়েছে বলেই সে রবীন্দ্রচর্চা করতে পারবে না, এমন তো কোনো কথা নেই।
তা নেই। রবীন্দ্রচর্চা, পিকাসোচর্চা, সব চর্চার মূল হচ্ছে টাকা। এইটা থাকলে সব কলার চর্চা করা যায়।
ইদরিসের যোগাযোগ এবং কাজ করবার, কাজ গোছাবার কায়দা দেখে রফিক সত্যিকার অর্থেই মুগ্ধ। একটি পয়সা অ্যাডভান্স না দিয়ে সে মতিঝিলে রফিকের জন্যে দু কামরার এক অফিস জোগাড় করে ফেলল। টি এণ্ড টির বড়ো বড়ো কর্তব্যক্তিদের সঙ্গে সে কী বলল কে জানে তাঁরা আশ্বাস দিলেন এক মাসের মধ্যে টেলিফোন লাইন পাওয়া যাবে। ফানিচারের দোকান থেকে বাকিতে ফানিচার চলে এল। রফিক মুখ শুকনো করে বলল, আমার তো ভাই ভয়-ভয় লাগছে, সামাল দেব কী ভাবে?
সামাল দেওয়ার লোকও তোর জন্যে ব্যবস্থা করেছি। এই লাইনের মহা ঘাগু লোক। তোর নতুন ম্যানেজার। নাম হল সাদেক আলি। তবে ব্যাটাকে বিশ্বাস করবি না। তোর বিশ্বাস অর্জনের সব চেষ্টা সে করবে। তুইও ভাব দেখাবি যে বিশ্বাস করছিস, কিন্তু আসলে না।
এ-রকম একটা লোককে তুই আমার সঙ্গে গেঁথে দিচ্ছিস কেন?
তোর ভালোর জন্যেই দিচ্ছি। সাদেক আলি তোর ফার্মকে দাঁড় করিয়ে দেবে। যখন দেখবি তুই নিজে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছিস, তখন ব্যাটাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবি।
এটা কেমন কথা?
খুবই জরুরি কথা। নয়তো ব্যাটা তোর সর্বনাশ করে ভাগবে।
রফিক খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। সব কিছু হচ্ছে ঝড়ের গতিতে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? শেষ পর্যন্ত বড়ো রকমের ঝামেলায় পড়তে হবে না তো? আমিও যাবে ছালাও যাবে। তার ভরাড়ুবি কি আসন্ন?
এইসব কথাবার্তা সে অবশ্য বাসায় কিছুই বলে নি। শারমিনের সঙ্গেও নয়। শারমিনের সঙ্গে তার একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। সন্ধির কোনো রকম ইশারাও পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে দু জন দু দিকে ফিরে ঘুমায়। এই অবস্থায় ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা জমে না। তাছাড়া শারমিনের সন্দেহ-বাতিক আছে। এক লক্ষ প্রশ্ন করবে-কেন তোমার এই বন্ধু তোমার জন্যে এত কিছু করছে? তার স্বাৰ্থ কী? তোমার কত দিনের বন্ধু? কই, আগে তো তার নাম শুনি নি। তার আসল মতলবটা কী?
এই জাতীয় প্রশ্ন রফিকের মনেও আছে বলেই সে অন্য কারো মুখ থেকে শুনতে চায় না। তারচে যেভাবে এগোচ্ছে এগোক।
নীলুর সঙ্গে এক বার অবশ্যি কিছু কথা হয়েছে। তাও ভাসা-ভাসা কথা। যেমন একদিন রফিক বলল, Arrorn International নামটা তোমার কেমন লাগে ভাবী?
ভালোই লাগে।
এটা হচ্ছে আমার ফার্মের নাম।
ফাৰ্ম আবার কবে দিলে?
দিইনি। এখনও। দেব।
ও, তাই বল। এখনও পরিকল্পনার স্টেজে আছে।
হুঁ, তবে খুব শিগগিরই ড্রামাটিক একটা ডিক্লেরেশন আমার কাছ থেকে শুনতে পাবে। তখন আকাশ থেকে পড়বে।
তোমার সব ডিক্লোরেশনই তো ড্রামাটিক।
রফিক আর কিছু বলল না। বেশি কিছু বলতে সাহসও হল না। যদি ব্যাঙ্কলোন শেষ পর্যন্ত না পাওয়া যায়? তয়ী সাধারণত তীরে এসেই ডোবে। মাঝনদীতে ডোবে না।
রফিক চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাঙ্কলোন নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে তাঁর নতুন ম্যানেজার।–সাদেক আলি। ভালোমানুষের মতো চেহারা। মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তি পুরোপুরি বিকশিত হয় নি। অথচ রফিক এর মধ্যেই বুঝেছে-এ মহা ধুরন্ধর।
সাদেক আলিকে নিয়েও রফিক সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় ভোগে। তার রাতে ভালো ঘুম হয় না। বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই দুঃস্বপ্নগুলিরও কোনো আগামাথা নেই। একটা স্বপ্ন ছিল এ-রকম–সে এবং সাদেক আলি প্ৰাণপণে ছুটিছে। দুজনের গায়েই কোনো কাপড় নেই। তাদের তাড়া করছে বাবলুর বয়েসী একদল ছেলে। সাদেক আলি বারবার বলছে—-এরা বড় যন্ত্রণা করছে। স্যার, বন্দুক দিয়ে একটা গুলী করেন।