মনজু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অফিসের আসবাবপত্র দেখতে থাকল। এই কাজটা সে আগেও করেছে। আরেকবার করতে ক্ষতি নেই। তার সামনে আজকের খবরের কাগজ আছে। ইচ্ছা করলে সে খবরের কাগজ পড়তে পারে। কিন্তু সেটা মনে হয় ঠিক হবে না। বড় সাহেবের সামনে বসে খবরের কাগজ পড়াটা অবশ্যই বেয়াদবি হবে। খুব বড়লোকদের মনে মনে গাল দিলে আরাম লাগে! মনজু একবার মনে মনে বলল, শালা মদারুণ! তেমন কোনো আরাম পেল না, বরং মনে হলো ব্যাটা তার মনের কথা বুঝে ফেলেছে। যখন সে শালা মদারু বলেছে তখন চট করে তাকিয়েছে।
মনজুর এখন মনে হচ্ছে হেডমাস্টার সাহেবের চিঠিটা না দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সোমেশ্বর হাইস্কুলের রিটায়ার্ড হেড়ম্বুষ্টার বাবু তারানাথ শীলের সঙ্গে তার দেখাই হয় নি। চিঠিটা সে নিজেই সূক্ষ্মধ্বসে লিখেছে। সে শুধু জানে এই মেগাবাস তারানাথ শীলের ছাত্র ছিলেনুষ্টিনি মোতাহার হোসেনকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হেডমাস্টার সাহেবের চিঠিতে দুজনের গতি হয়েছে। তার যদি গতি হয় তাহলে দানে দানে তিন দান হবে।
বড় সাহেবের ডান দিকের জানালায় ভ্যানিশিং ব্লাইন্ড লাগানো। সময় কাটানোর জন্যে টুকরাগুলি গোনা যেতে পারে। যদি জোড় সংখ্যা হয় তাহলে তার গতি হবে। বেজোড় হলে হবে না। গোনার সময় মনজু মনে মনে আরেক দফা গালি দিল, এই শুয়োর, আমি যে এতক্ষণ বসে আছি তোর চোখে পড়ছে না? তুই মানুষকে মানুষ বলে গ্রাহ্য করিস না। কাপড় খুলে তোর পাছায় কচ্ছপ দিয়ে কামড় দেওয়াব।
এই, এদিকে এসো!
মনজু চমকে উঠল। তাকেই কি ডাকা হচ্ছে? হ্যাঁ, বড় সাহেব তো তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এখন তার কী করা উচিত? প্রথম ঘরে ঢোকার সময় সে একবার সালাম দিয়েছে। আবার কি দেওয়া উচিত? সালাম দুই-তিন বার দিলে কোনো দোষ হবে না তো?
স্যার, স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। তোমার ব্যাপার কী?
একটা চিঠি নিয়ে এসেছিলাম স্যার।
কার চিঠি?
সোমেশ্বর হাই স্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টার বাবু তারানাথ শীলের চিঠি। উনি বলেছেন চিঠিটা আপনাকে হাতে হাতে দিতে।
মোতাহার হোসেন বেশ আগ্রহ করেই চিঠি নিলেন। খাম খুলে সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করলেন। মনজু একমনে দরুদে শেফা পড়ছে। কঠিন পরিস্থিতিতে এই দোয়া পাঠ করলে পরিস্থিতি সহজ হয়। যে ব্যক্তি ভক্তিসহ এই দরুদ পাঠ করে পরিস্থিতি তার অনুকূলে যায়। চিঠি পড়তে গাধাটার এতক্ষণ লাগছে কেন? বানান করে করে পড়ছে? লেখাপড়া জানে না না-কি?
এক পাতার চিঠিতে লেখা আছে–
বাবা মোতাহার,
পত্রবাহক আমার অক্তি প্রিয় একজন। ভদ্র পরিবারের ভালো এবং সৎ ছেলে। তাহার কর্তৃক আমি নানানভাবে উপকৃত হইয়াছি। এখন সে বড়ই দুরবস্থায় পড়িয়াছে। তাহার দুঃসময়ে আমি কিছু সাহায্য করি ঈশ্বর আমাকে সেই ক্ষমতা দেন। তোমাকে দিয়াছেন। তুমি যদি আমার এই অতি প্রিয় ছেলেটির জন্য কিছু করিতে পার তাহা হইলে আমি বৃদ্ধ বয়সে বড়ই শান্তি পাইব। শরীর ভালো যাইতেছে না। পরপারে ভ্রমণের জন্যে প্রস্তুতি নিতিছি। তুমি ভালো থাকিবে। বৌমাকে আমার স্নেহ এবং তোমার পুত্ৰ শুভ্রর প্রতি আন্তরিক শুভকামনা।
ইতি
তোমার শিক্ষক
তারানাথ শীল
মোতাহার হোসেন চিঠিটা টেবিলে রেখে অ্যাসট্রে দিয়ে চাপা দিতে দিতে বললেন, চিঠিতে লেখা তুমি স্যারের অতি প্রিয় একজন। স্যার তোমাকে দিয়ে উপকৃত হয়েছেন। তুমি কী করেছ তার জন্যে?
মনজু বলল, তেমন কিছু করি নাই স্যার। টুকটাক সেবা। পাশে বসে গল্পগুজব। উনি মহৎপ্রাণ মানুষ। আমার ছোট কাজটাকেই বড় করে দেখেছেন।
মোতাহার হোসেন বললেন, চিঠিটা কি উনার লেখা?
মনজুর বুক ধ্বক করে উঠল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, স্যার, উনার প্যারালাইসিস। উনি হাতে কিছু লিখতে পারেন না। উনি ডিকটেশন দিয়েছেন, অন্য একজন লিখেছে।
অন্য একজনটা কে, তুমি?
জি স্যার।
মোতাহার হোসেন এই পর্যায়ে এসে কিছুক্ষণ সরাসরি মনজুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনজু চোখের দৃষ্টি দেখেই বুঝেছে দরুদে শেফা কাজ করে নি। আজ তার খবর আছে। এই লোকের সামনে মিথ্যা কথা বলাও সম্ভব না।
তোমার নাম যেন কী?
শফিকুল করিম। ডাক নাম মনজু।
আমার তো ধারণা সোমেশ্বর স্কুলের রিটায়ার্ড কোনো হেডমাস্টারের সঙ্গে তোমার দেখাই হয় নি। আমার ধারণা কি ঠিক?
মনজু দেরি করল না। সঙ্গে সঙ্গে বলল, জ্বি স্যার ঠিক।
পড়াশোনা কী?
বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম, পাশ করতে পারি নি।
পুলিশের কাছে কখনো ধরা পড়েছ? হাজত খেটেছ?
জি-না স্যার।
তুমি বাইরে যাও। অপেক্ষা করা। তোমাকে পরে ডাকব।
স্যার, আমি বরং চলে যাই?
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। অ্যাসট্রে দিয়ে চাপা দেয়া চিঠি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিলেন। টেলিফোন তুলে কাকে যেন কী বললেন। মনজু বাঘের খাঁচা থেকে বের হয়ে এলো। ঠাণ্ডা ঘরে বসে থাকার পরেও তার কপাল ঘামছে। বুক ধরফড় করছে। এই মুহুর্তে পরপর দুটা সিগারেট খেয়ে তাকে শরীর ঠিক করতে হবে। অফিসে সিগারেট খাওয়া যাবে না। তাকে চলে যেতে হবে। রাস্তায়। রাস্তার পাশের ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলি ভালো চা বানায়। মিষ্টি বেশি দিয়ে এক কাপ চা, সঙ্গে দুটা সিগারেট। দুটা সিগারেট পর পর খাবার আলাদা নাম আছে– মামা-ভাগ্নে সিগারেট। প্রথমটা মামা সিগারেট, এতে নেশার ক্ষেত্র তৈরি হয়। দ্বিতীয়টা ভাগ্নে সিগারেট। তখন নেশাটা জমে।