জাহানারা বললেন, এই বাড়িতে লিসনার-টাইপ কেউ আছে?
শুভ্র বলল, সকিনা মেয়েটা লিসনার।
জাহানারা হতভম্ব হয়ে বললেন, একটা কাজের মেয়ে হয়ে গেল লিসনার? তাকে তো কথা শুনতেই হবে। সে তো মুখের উপর হড়বড় করে কথা বলবে না।
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন মা?
জাহানারা বললেন, তোর উল্টাপাল্টা কথা শুনে রাগ লাগছে। আমাকে রাগানোর জন্যে তুই কথাগুলি ইচ্ছা করে বলিস কি-না কে জানে। আমি লক্ষ করেছি। তোর সবসময় একটা চেষ্টা থাকে। আমাকে রাগিয়ে দেবার।
শুভ্ৰ হাসছে। জাহানারা জানেন ছেলের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার রাগ পড়ে যাবে। তিনি অন্যদিকে তাকালেন। ছেলে হাসুক তার মতো। হাসি দেখার দরকার নেই। জাহানারা উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে রওনা হলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন। ছেলে তাকে রাগ করে চলে যেতে দেবে না। ডেকে আবার চেয়ারে বসাবে। শুভ্র তা করল না। সে আবারো কম্পিউটার চালু করল। জাহানারা হঠাৎ মনে এত কষ্ট পেলেন যে চোখে পানি এসে গেল।
বসদের অফিস ঘর
বসদের অফিস ঘর থাকে এক রকম, আবার সুপার ড়ুপার বসদের অফিসঘর থাকে অন্যরকম। তাদের অফিসঘরে পা দেয়া মাত্ৰই চাপা গলায় বলতে ইচ্ছা করেখাইছে রে! তারপরেই মনে হয়— আমি কোথায় ঢুকলাম? জাহাজের ইঞ্জিনাঘরের শব্দের মতন শব্দ (তবে অনেক হালকা) মাথার ভেতর পিনপিন করতে থাকে। সারাক্ষণ অস্বস্তি— শব্দটা কোথেকে আসছে? শব্দটা যে এসি থেকে আসছে এটা বোঝা যায় না। কারণ এই জাতীয় বসদের ঘরের এসি লুকানো থাকে। চোখে দেখা যায় না। ঘর থাকে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। চৈত্র মাসের গরমের দিনে মাঘ মাসের শীত। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের অন্যপ্রান্তে যিনি বসে থাকেন তার চোখও থাকে। ঠাণ্ডা। ঘরে আলো থাকে কম— চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ধরনের আলো। দর্শনার্থীদের জন্যে সোফা থাকে। সেই সোফাও সেক্রেটারিয়েট টেবিলের মতো বিশাল। বস্যামাত্র শরীর ড়ুবে যায়। পা শুধু ভেসে থাকে। চোখের সামনে বকের ঠ্যাং-এর মতো দুটো লম্বা পা নিয়ে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগে।
মনজু অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসে আছে। তার সামনের ভদ্রলোকের নাম মোতাহার হোসেন। সিনেমার বিজ্ঞাপনে যেমন থাকে মেগাস্টার, উনিও মেগাবাস। জাহাজের ব্যবসা, গার্মেন্টসের ব্যবসা, সুতার কারখানা, রঙের কারখানা… হুলুস্থল। শুধু হুলুস্থূল না, মেগা হুলুস্থূল। মনজু এই ভদ্রলোকের জন্যে সোমেশ্বর হাই স্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টার সাহেবের একটা চিঠি নিয়ে এসেছে। গত চারদিন ধরে এই চিঠি নিয়ে সে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছে। দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। অফিসের লোকজন কিছুতেই তাকে ঢুকতে দেবে না। মনজু বলেছে, ভাই, আমি কোনো চাকরির জন্যে আসি নাই। কোনো সাহায্যের আবেদনও না। হেডমাস্টার সাহেবের একটা ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে এসেছি। মোতাহার হোসেন সাহেব উনার ছাত্র। বিশেষ স্নেহভাজন ছাত্র। চিঠিতে উনি গোপন কিছু কথা তার ছাত্রকে লিখেছেন। প্রাইভেট কথা।
অফিসের লোক (মনে হয় মেগাবসের সেক্রেটারি) শুকনা গলায় বলল, চিঠি রেখে যান, আমরা স্যারের কাছে পৌছে দেব।
মনজু বলল, এই চিঠি আমাকে হাতে হাতে দিতে হবে। স্যারের বিশেষ নির্দেশ। চিঠি পড়ার সময় আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে। চিঠি পড়ার পর আমাকে দুএকটা প্রশ্ন আপনার স্যার করলেও করতে পারেন।
লোক বলল, আপনার ঠিকানা রেখে যান। চিঠি পড়ার পর স্যার যদি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান আমরা আপনাকে খবর দেব।
উনি কি কারো সঙ্গে দেখা করেন না?
না।
মনজু মেগাবসের বাড়িতে গিয়েছে। ওয়ারিতে হুলস্থূল টাইপ বাড়ি। মেগা হাউস! জেলখানার গেটের চেয়েও উঁচু দেয়াল দিয়ে বাড়ি ঘেরা। শ্বেতপাথরের নেমপ্লেটে ইংরেজিতে লেখা Maya Lodge, সব বাড়ির গেটে একজন দারোয়ান থাকে- এই বাড়ির গেটে তিনজন দারোয়ান। তাদের এক কথা, আপনি অফিসে যান। বাড়িতে কারোর ঢোকার অনুমতি নাই।
মনজু বলল, মন্ত্রী মিনিস্টাররাও তো মাঝে মধ্যে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
তিন দারোয়ানের একজন। (চশমা চোখের দারোয়ান। দারোয়ানদের চোখে চশমা দেখা যায় না। ব্যাটা বোধহয় জ্ঞানী) বলল, বিরক্ত করবেন না। বিরক্ত করলে লাভ হবে না। অফিসে যান।
মনজু বলল, কোন অফিসে যাব? উনার তো অফিস অনেকগুলি।
চশমা চোখের দারোয়ান বলল, সেটা আপনার বিবেচনা। ভাই, বিরক্ত করবেন না।
কোন অফিসে গেলে দেখা করা সহজ?
জানি না।
দেখা করা আমার স্বার্থে না, উনার স্বার্থে। উনারই উপকার হবে, আমার কিছু না।
চশমাওয়ালা দারোয়ান বলল, প্যাচাল বন্ধ করেন।
মনজু প্যাচাল বন্ধ করে চলে এসেছে এবং ফন্দি ফিকির করে বাঘের খাঁচায় ঢুকেও পড়েছে। কীভাবে ঢুকল সে এক ইতিহাস। এখন মনে হচ্ছে খাঁচায় ঢুকে কোনো লাভ হবে না। গত চারদিনের পরিশ্রম বুড়িগঙ্গার ঘোলা পানিতে পড়েছে। বুড়িগঙ্গার কোনো উনিশ বিশ হয় নি। তার নিজের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে।
যে ব্যক্তিটির সামনে সে বসে আছে সেই ব্যক্তিটিকে তেমন ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরে আছে। পাঞ্জাবিতে ইস্ত্রি নেই। কাপড়টাও খুব দামি বলে মনে হচ্ছে না। সহজ মানুষ বলেই তো মনে হচ্ছে। তবে চল্লিশ মিনিট যে লোক কোনোরকম নড়াচড়া না করে ঝিম ধরে বসে থাকতে পারে সে কোনো সে কোনো সহজ পাত্ৰও না। মনজুর ধারণা ছিল অফিসে বড় সাহেবদের কাছে ক্ৰমাগত লোকজন আসতে থাকে। বড় সাহেব তাদের সবাইকে ধমকাতে থাকেন। টেলিফোন বাজতে থাকে, তিনি টেলিফোন ধরতে থাকেন। টেলিফোনেও ধমকধামক করতে থাকেন। অতি রূপবতী স্টেনোরা একটু পর পর এসে নোট নেয়। চা-কফি দিয়ে যায়। এই বড় সাহেব সে-রকম না। চল্লিশ মিনিটে কেউ তার কাছে অ্যাসে নি। কোনো টেলিফোন বাজে নি। উনাকে সম্ভবত টেলিফোন করাও নিষেধ।