ডাকলেই পারেন।
রাজকুমার অনেক বড় নাম। ডাকনাম হতে হয় তিন অক্ষরের মধ্যে।
এইসব নিয়মকানুন তো মা আমি জানি না।
জাহানারা পাশ ফিরলেন। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুম এখনো আসে নি, এর মধ্যেই তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। স্বপ্নে শুভ্র এসে ঢুকেছে। তার ঘরে। তার মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ। মাথার চুলও বাউলদের মতো লম্বা। চুল দাড়ির রঙ কালো না, খয়েরি। শুভ্র বলল, মা, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বলো তো। তিনি বললেন, তোকে হনুমানের মতো দেখাচ্ছে। শুভ্র বলল, হনুমানের কি দাড়ি আছে? তিনি বললেন, আছে কি-না তা জানি না। তোকে যে হনুমানের মতো দেখাচ্ছে এটা জানি। শুভ্র বলল, মা, আমি যদি তোমার পাশে শুয়ে থাকি তাহলে কি কোনো সমস্যা আছে? তিনি বললেন, অবশ্যই সমস্যা আছে। মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে আমি কোনো হনুমানকে আমার পাশে শুতে দেব না। তুই দাড়ি গোঁফ কামিয়ে আয়, তারপর বিবেচনা করব। শুভ্র নিষেধ সত্ত্বেও মার পাশে শুয়ে পড়ল। তিনি বললেন, বাবা, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো।
শুভ্ৰ মার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার আঙুলগুলি বরফের মতো ঠাণ্ড। কী যে আরাম লাগছে। জাহানারা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
জাহানারার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার বিছানার পাশে শুভ্র বসে আছে। তার চোখ ঘুম ঘুম। যেন সে এতক্ষণ সত্যি সত্যি তার পাশেই শুয়েছিল। শুভ্র বলল, মা, তোমার কি শরীরটা খারাপ?
তিনি বললেন, না।
দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছ, মাইগ্রেনের ব্যথা না তো?
জাহানারা পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন, মাইগ্রেনের ব্যথা হলে তুই কী করবি?
শুভ্র বলল, মন্ত্র পড়ে ব্যথা কমাব। উইচক্রাফটের বই থেকে মন্ত্র শিখেছি। পড়ব মন্ত্রটা?
জাহানারা মুগ্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। দিনের শেযবেলায় সব মানুষকেই সুন্দর লাগে, সেখানে শুভ্ৰকে দেবদূতের মতো লাগবে সেটাই তো স্বাভাবিক। শুধু সে যদি কালো রঙের একটা হাফ শার্ট পরত! কালো রঙে শুভ্রর গায়ের আসল রঙ ফুটে বের হতো।
শুভ্র বলল, চুপ করে আছ কেন মা? মন্ত্র পড়ব?
জাহানারা ছেলের কোলে হাত রাখতে রাখতে আদুরে গলায় বললেন, পড় দেখি তোর মন্ত্র।
শুভ্র বলল, এই মন্ত্রের জন্যে আগরবাতি জ্বালাতে হবে।
জাহানারা বললেন, আগরবাতি এখন কোথায় পাবি?
শুভ্ৰ হাসিমুখে বলল, আগরবাতি আমি সঙ্গে করে এনেছি।
জাহানারা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তার মন বলছে এই ছেলেকে তিনি পুঝতে পারেন না। এতক্ষণ ভাবছিলেন শুভ্ৰ মাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে মান খারাপ করেছে। মন্ত্র পড়ে মার মাথার ব্যথা সারাতে চাচ্ছে। এখন তার কাছে মনে হচ্ছে শুভ্রর কাছে পুরো ব্যাপারটাই খেলা। সে এক ধরনের মজা করবে বলে কাউকে দিয়ে আগরবাতি আনিয়েছে। আগরবাতি জ্বালাবার জন্যে পকেটে করে নিশ্চয়ই দিয়াশলাইও এনেছে।
শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। দুটা আগরবাতির স্টিক জ্বালাল। মায়ের কপালে হাত রেখে ভারী গম্ভীর গলায় বলল,
Change this incense strong and fast
To send out the magic I shall cast.
Burn so quickly and burn so bright,
This magic incense I will light.
জাহানারার কেমন যেন লাগছে। সারা শরীরে শান্তি শান্তি ভাব। শুভ্র মন্ত্রটা সুন্দর করে পড়েছে তো।
শুভ্র বলল, মা, মাথাব্যথা চলে গেছে না?
জাহানারা বললেন, চলে গেছে।
শুভ্র বলল, এরপর যদি কখনো মাথাব্যথা হয় দরজা-জানালা বন্ধ করবে না। আমাকে ডাকবে, মন্ত্র পড়ে মাথাব্যথা সারিয়ে দেব।
জাহানারা বললেন, আচ্ছা। খবর দেব।
শুভ্ৰ উঠে যাবার ভঙ্গি করতেই জাহানারা ছেলের হাত ধরে ফেললেন। আদুরে গলায় বললেন, সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত তুই এখানে বসে থাকিবি। নড়তে পারবি না।
শুভ্র বলল, আচ্ছা।
জাহানারা বললেন, তুই তো প্রায়ই তোর বাবার সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করিস। আমার সঙ্গে কর।
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, কোন বিষয়ে গল্প শুনতে চাও মা?
জাহানার বললেন, যে-কোনো। বিষয়ে। শুধু তোর বাবার সঙ্গে যে-সব গল্প করিস সে-সব না। ফিজিক্সের কচকচানি না।
স্বপ্নের গল্প বলব?
স্বপ্নের আবার কী গল্প?
শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে আমি যে-সব স্বপ্ন দেখি।
জাহানারা আগ্রহ নিয়ে বললেন, নিজেকে নিয়ে তুই কী স্বপ্ন দেখিস?
শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে মানুষ একেক বয়সে একেক রকম স্বপ্ন দেখে— এখন আমি যে স্বপ্ন দেখি তা হলো সমুদ্রে একটা ছোট্ট দ্বীপ। গাছপালায় ঢাকা। একদিকে ঘন জঙ্গল। সমুদ্রে যে দিকে সূর্য ড়ুবে দ্বীপের সেই দিকটায় বেলাভূমি। রবিনসন ক্রুশোর মতো আমি সেই দ্বীপে একা থাকি।
একা থাকিস?
হ্যাঁ একা। আমার একটা ছোট্ট ঘর আছে। ঘর ভর্তি শুধু বই। যখন ইচ্ছা হয় বই পড়ি। যখন ইচ্ছা হয় সমুদ্রে পা ড়ুবিয়ে পাথরের উপর বসে থাকি। যখন ইচ্ছা হয় জঙ্গলে হাঁটতে যাই।
জাহানারা বললেন, রান্নাবান্না কে করে?
রান্নাবান্নার কথাটা ভাবি নি মা। স্বপ্নের মধ্যে রান্নাবান্না, বাথরুম জাতীয় ব্যাপার আনতে নেই। এইসব হচ্ছে রিয়েলিটি। ড্রিমের সঙ্গে রিয়েলিটি মেশাতে নেই।
একা একা তোর সেই দ্বীপে কতক্ষণ ভালো লাগবে?
শুভ্র বলল, বাস্তবে হয়তো ভালো লাগবে না, কিন্তু স্বপ্নে ভালো লাগবে।
জাহানারা বললেন, তুই যেমন অদ্ভুত, তোর স্বপ্নগুলিও অদ্ভুত।
শুভ্র বলল, প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তাদের স্বপ্নও আলাদা। আমার স্বপ্নের সঙ্গে তোমার স্বপ্ন কখনো মিলবে না। তোমার স্বপ্ন কী মা বলো তো।