মোতাহার হোসেন তার চা খাবার জায়গায় এসে বসলেন। তার হাতে টগর লেখা চিরকুট। চট করে তার মাথায় ম্যাজিকের রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। শুভ্র দশটা ফুলের নাম লিখে এই ধরনের চিরকুট দশটা জায়গায় সাজিয়ে রেখেছে। যদি টগর না বলে গোলাপ বলতেন তাহলে হয়তো গোলাপ লেখা চিরকুটটা একটা বইয়ের নিচ থেকে বের হতো। মূল ব্যাপার হলো কোন ফুলের চিরকুট কোথায় লুকানো সেটা মনে রাখা।
এই তুমি এতক্ষণ কী করলে?
জাহানারা খুবই বিরক্ত হয়ে মোতাহার হোসেনের দিকে এগুলেন। ঝাঁঝালো গলায় বললেন, তিনটা প্রশ্ন করতে গিয়ে দিন পার করে দিলে? শুভ্র কী বলেছে? সে মাথা দুলিয়ে বই পড়ছিল কেন?
মোতাহার হোসেন বললেন, তার মাথার ভেতর গান বাজছিল। গানের তালে তালে সে মাথা নাড়ছিল।
জাহানারা আতঙ্কিত গলায় বললেন, মাথার ভেতর গান বাজছিল মানে কী? এটা আবার কোন ধরনের অসুখ?
মোতাহার হোসেন বললেন, এটা কোনো অসুখ না। সবার মাথার ভেতরই গান বাজে। তোমারও বাজে।
না, আমার মাথার ভেতর কোনো গান ফান বাজে না; আর বাজলেও আমি এইভাবে মাথা ঝাকাই না। শুভ্র কী বই পড়ছিল?
ম্যাজিকের বই।
এই বয়সে সে ম্যাজিকের বই পড়বে কেন? এইসব বই সিক্স সেভেনে পড়বে। এতক্ষণ তোমরা কী করলে?
শুভ্র আমাকে একটা ম্যাজিক দেখাল। এই জন্যেই দেরি হলো। ফুলের একটা ম্যাজিক।
কী ম্যাজিক?
সে দশটা ফুলের একটা লিষ্ট করে আমাকে বলল, যে কোনো একটা ফুলের কথা মনে মনে ভাবতে। আমি টগর ফুলের কথা ভাবলাম। সে তার ট্যালিপ্যাথিক ক্ষমতা দিয়ে বলে দিল। ইন্টারেস্টিং ম্যাজিক।
জাহানারার খুবই খারাপ লাগছে। ছেলে তার বাবাকে ম্যাজিক পর্যন্ত দেখিয়ে ফেলেছে। অথচ তার সঙ্গে যে কথা বন্ধ এটা পর্যন্ত তার মনে নেই। যেন এই বাড়িতে জাহানারা নামের কোনো মহিলা বাস করেন না।
শেভ করা বন্ধ করেছে কেন- এটা জিজ্ঞেস করেছ?
জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর দেয় নি। তবে আমি যা ধারণা করেছি তাই।
তোমার ধারণার কথা তো আমি শুনতে চাচ্ছি না। ওর ধারণাটা জানতে চাচ্ছি। তুমি আবার শুভ্রর কাছে যাও। ভালোমতো জেনে আস।
মোতাহার হোসেন বললেন, তুমি তোমার ঘরে যাও। দুটা দশ মিলিগ্রামের রিলক্সিন ট্যাবলেট খেয়ে, দরজা-জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাক। আমি নিশ্চিত তোমার প্রেসার বেড়েছে। নাক ঘামছে। গাল লাল। তোমার কথাবার্তাও জড়িয়ে যাচ্ছে।
তুমি শুভ্রর কাছে যাবে না?
না। তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমি মাতামাতি করি না।
তুমি কী নিয়ে মাতামাতি কর?
মোতাহার হোসেন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। চোখ নামালেন না। তার এই দৃষ্টির সঙ্গে জাহানারা পরিচিত। তিনি শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। এই সময় শুভ্র তার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তার মুখ হাসি হাসি। ভারী চশমার ভেতর দিয়েও তার সুন্দর চোখ দেখা যাচ্ছে। শুভ্র এগিয়ে আসছে তার দিকেই। জাহানারা থমকে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে ছেলের মনে পড়েছে মার সঙ্গে কথা হচ্ছে না। তাও ভালো। জাহানারা ঠিক করে ফেললেন, ছেলের সঙ্গে প্রথম বাক্যটা কী বলবেন। ঠিন গলায় বলবেন, শুভ্র বাবা, বাথরুমে যাও। ক্লিন শেভ হয়ে বের হয়ে আস। সন্ন্যাসী সাজ আমার পছন্দ না।
কী আশ্চর্য, শুভ্র তাকে কিছু না বলে তার বাবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মোতাহার হোসেন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, Hello young man!
শুভ্র বলল, Hello old man and the sea!
তুই আমার সামনে বসে। দশটা ফলের নাম বল। তোকে আমি মজার একটা ট্যালিপ্যাথিক খেলা দেখাব।
জাহানারা নিজের ঘরে ঢুকলেন। দুটা রিল্যাক্সিনের জায়গায় চারটা রিল্যাক্সিন খেলেন। সকিনাকে ডেকে বললেন, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিতে। সকিনা তার কাজের মেয়ে। সকিনার একমাত্র ডিউটি হচ্ছে তার সেবাযত্ন করা। সকিনার বয়স অল্প। চেহারা সুন্দর। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় বলেই বোধহয় ভাষা সুন্দর। অন্য বুয়াদের মতো আইছি খাইছি বলে না, এসেছি খেয়েছি বলে।
সকিনা বলল, মা, আপনের শরীর খারাপ?
তিনি বললে, শরীর ঠিক আছে।
সকিনা বলল, মাথায় তেল দিয়ে দেব?
দাও। তার আগে এসি ছাড়। ম্যাক্সিমাম কুলে দাও। হাতের কাছে একটা চাদর রাখ। ঘর ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আমার গায়ে চাঁদর দেবে। আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে কেউ যেন আমার ঘুম না ভাঙায়। শুধু শুভ্র এসে ডাকলে ঘুম ভাঙাবে।
ঠিক আছে মা।
আমি দুপুরে খাব না। খাবারের সময় ডাকবে না। শুভ্ৰ যদি খেতে বসে আমাকে ডাকে তাহলে ঘুম থেকে তুলবে।
ঠিক আছে মা।
সকিনা চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। জাহানারা আরাম পাচ্ছেন। এই মেয়েটা চুলে বিলি করার ব্যাপারটা জানে। সে গুছিয়ে কথা বলতে ও জানে। আম্মা না বলে সে বলে মা। মা শুনতে ভালো লাগে।
সকিনা!
জি মা!
শুভ্রর মতো সুন্দর ছেলে কি তুমি তোমার জীবনে দেখেছ?
জি-না।
আমাকে খুশি করার জন্যে কোনো কথা বলবে না। খুশি করানো কথা আমার পছন্দ না। সত্যিটা বলে।
ভাইজানের মতো সুন্দর ছেলে আমি দেখি নি মা।
জাহানারা ঘুম ঘুম চোখে বললেন, স্কুলে ছেলেরা শুভ্রকে ডাকত লালটু। স্কুলের ছেলেরা পাজি হয় তো, এই জন্যে পাজি পাজি নাম দেয়। কলেজে তাকে সবাই ডাকত প্রিন্স। ইউনিভার্সিটিতে তার কী নাম হয়েছে জানো?
জানি মা। আপনি একবার বলেছেন- রাজকুমার।
কী সুন্দর নাম তাই না? মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে তাকে শুভ্ৰ না ডেকে রাজকুমার ডাকি।