সকিনা বলল, মা, কাঁদবেন না।
জাহানারা রাগী গলায় বললেন, আমি কাঁদছি, তোমাকে কে বলল ফাজিল মেয়ে?
জাহানারা শব্দ করেই কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, সকিনা, তুমি দেখে এসো, এখনো তারা গল্প করছে কি-না।
মোতাহার হোসেন এতক্ষণ চেয়ারে বসেছিলেন। এখন চেয়ার ছেড়ে খাটে উঠে এসেছেন। পিতা-পুত্র দুজনই খাটে। শুভ্ৰ আগের মতোই পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসেছে। মোতাহার হোসেন খাটের মাথায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছেন। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ছেলের সঙ্গে গল্প করতে তার বেশ ভালো লাগছে। মোতাহার হোসেন বললেন, তোর মা কাল তোকে নিয়ে কী একটা উৎসব না-কি করবে?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ কাল উৎসব। জন্মদিন পালন করা হবে।
মোতাহার হোসেন বললেন, জন্মদিনে তোকে কী উপহার দেয়া হবে তুই কি জানিস?
শুভ্র বলল, জানি না, তবে অনুমান করতে পারি।
অনুমান কর।
আমি একবার মাকে আমার স্বপ্নের কথা বলছিলাম। একা রবিনসন ক্রুশোর মতো একটা দ্বীপে থাকব। তখন লক্ষ করেছি। মার চোখ চকচক করে উঠেছে। সেখান থেকে ধারণা করছি, মা হয়তো আমাকে একটা দ্বীপ দেবে। মনে হয় দ্বীপটিা কেনা হয়েছে। যে কারণে তাড়াহুড়া করে মা জন্মদিনের উৎসব করছে। বাবা, দ্বীপ কি তুমি কিনেছ?
মোতাহার হোসেন বললেন, তোর বুদ্ধি ভালো। শুধু বুদ্ধি বলা ঠিক হবে না। বুদ্ধি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা ভালো। অনেকের বুদ্ধি থাকে। সেই বুদ্ধি কাজে খাটিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না।
শুভ্র বলল, আমার তো তেমন কোনো কােজ নেই বাবা। আমি বেশিরভাগ সময় কাটাই বিছানায় শুয়ে শুয়ে। অন্ধ হবার জন্যে অপেক্ষা করা। অপেক্ষা করতে করতে নানান বিষয় নিয়ে ভাবি। গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়তো এইভাবেই ডেভেলপ করেছে। একটা বিশেষ ভাবনার কথা তোমাকে বলল?
বল।
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, মা যে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে— এটা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। কোনো মা তার সন্তানকে এত ভালোবাসবে না। কারণ সে জানে এই সন্তানটি তার। সে তারই অংশ। তাকে এত ভালোবাসার কিছু নেই। যখন কোনো মা উন্মাদের মতো তার সন্তানকে ভালোবাসবে, তখন বুঝতে হবে এই সন্তানটি আসলে তার না। সে প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে সন্তানটিকে নিজের করে নিতে। আমার কী মনে হয় জানো বাবা?
মোতাহার হোসেন বললেন, কী মনে হয়?
শুভ্র আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমার মনে হয় প্রথম ছেলেটি জন্মের পরপর মারা যাওয়ায় মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরেরটির মৃত্যুর পর তাঁর অসুস্থতা প্রচণ্ড বেড়ে গেল, তখন তুমি কোনো জায়গা থেকে আমাকে যোগাড় করে মার কাছে দিয়েছিলে।
মোতাহার হোসেন শান্ত গলায় বললেন, তোর এরকম মনে হয়?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ। বাবা, আমি যা বলছি তা কি ঠিক?
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শুভ্র বলল, তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমার কোনোরকম মিল নেই। চিন্তায় ভাবনায় কোনো কিছুতেই না। আমি জেনেটিকেলি তোমাদের চেয়ে আলাদা। কফি খাবে? আরেক কাপ কফি বানিয়ে দেই?
মোতাহার হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, না।
শুভ্র বলল, গল্প থাক। এখন এসো বুদ্ধির খেলা খেলি। বাবা, তুমি খেলবে?
মোতাহার হোসেন বললেন, না।
শুভ্র বলল, তোমার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে।
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না, আরেকটা সিগারেট ধরালেন।
শুভ্র বলল, বাবা, আমার কথা শুনে তোমার কি মনে হচ্ছে। আমি খুব কষ্টে আছি?
মোতাহার হোসেন বললেন, মনে হচ্ছে না।
শুভ্র বলল, আমি কষ্টে নেই। নিজের ব্যাপারটা নিয়ে আমি যখন ভাবি তখন আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।
ইন্টারেস্টিং কোন অৰ্থে?
শুভ্র বাবার কাছে এগিয়ে এলো। আগ্রহ নিয়ে বলল, প্রকৃতি নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে মানুষ নামক ভয়ঙ্কর বুদ্ধিমান একদল প্রাণী তৈরি করেছে। প্রকৃতি কেন এই কাজটা করেছে অতি বুদ্ধিমান মানুষ কিন্তু এখনো তা বের করতে পারে নি। মানবজ্জাত তার অস্তিত্বের কারণ না জেনেই এতদূর এসেছে, আরো অনেক দূর যাবে। তাকে ঘিরে থাকবে প্রচণ্ড সংশয়। সে কে? সে কোথা থেকে এসেছে? সে কোথায় যাচ্ছে? এই সংশয়ের তুলনায় আমার ব্যক্তিগত সংশয়টা কি খুবই তুচ্ছ না?
মোতাহার হোসেন বললেন, তোর মতো চিন্তা করলে হয়তো তুচ্ছ।
শুভ্র বলল, নিজের কথা ভেবে আমার মানসিকতায় কিছু পজেটিভ পরিবর্তন হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। আমি যখন সকিনাকে দেখি তখন তার উপর খুব মায়া লাগে। তাকে খুবই আপন লাগে। আমার মনে হয় সুলেমান চাচা যেমন অতি দরিদ্র কোনো ঘর থেকে সকিনাকে নিয়ে এসেছিলেন, আমাকেও নিশ্চয়ই সেরকম কোনো পরিবার থেকে এনেছেন। বাবা, মানুষের প্রতি আমার মমতা যে কী পরিমাণ বেড়েছে সেটা আমি জানি। আমি তোমাদের সত্যি ছেলে হলে এই মমতা তৈরি হতো না।
শুভ্ৰ চুপ করল। মোতাহার হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, কথা শেষ, না আরো কিছু বলবি?
শুভ্র বলল, আমার মধ্যে আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে, সেটাও বলি- গৌতম বুদ্ধের মতো সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে গৃহত্যাগ করতে আমার যেমন একটুও খারাপ লাগবে না, আবার আস্ত একটা দ্বীপ নিয়ে বাস করতেও খারাপ লাগবে না। বাবা তুমি বলো, মানসিকতার এই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না?
মোতাহার হোসেন ছেলের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুভ্ৰকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, Do you want to know about your parents?