মোতাহার হোসেন জানিয়েছেন, তার শরীর খুবই খারাপ। ডাক্তারের নির্দেশে তিনি বিছানাতেই বন্দি। একটু সুস্থ হলে তিনি নিজেই দেখা করবেন।
শুভ্রর ঘরে বাতি জুলছিল। মোতাহার হোসেন ধোয়াঘর থেকে সিগারেট শেষ করে ছেলের ঘরে উঁকি দিলেন। ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করছে।
শুভ্ৰ বিছানায় পদ্মাসন হয়ে বসে আছে। তার চোখ বন্ধ। মোতাহার হোসেন আনন্দিত গলায় বললেন, Hello young man.
শুভ্র চোখ মেলতে মেলতে বলল, Hello oldman and the sea.
মোতাহার হোসেন বললেন, ধ্যান করছিস না-কি?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ। আজ আষাঢ়ি পূর্ণিমা তো…
আষাঢ়ি পূর্ণিমায় ধ্যান করতে হয় না-কি?
এই দিন গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করেছিলেন, কাজেই ভাবলাম তাঁর স্টাইলে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকি। উনি বোধিবৃক্ষের নিচে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসতেন। আমি কম্পিউটারের নিচে পদ্মাসনে বসেছি।
মোতাহার হোসেন ছেলের পাশে বসতে বসতে বললেন, গৌতম বুদ্ধ ঝড়বৃষ্টির রাতে ঘর ছাড়লেন?
শুভ্র বলল, উনি ফকফকা জোছনায় ঘর ছেড়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে। এই দেশে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমাতে বৃষ্টি হবেই। বাবা, কফি খাবে? কফি বানিয়ে দেই?
দে।
কীভাবে কফি বানাব একটু দেখ বাবা। চোখ বন্ধ করে কফি বানোব। যাতে অন্ধ হয়ে যাবার পর আমার আর কোনো সমস্যা না হয়।
মোতাহার হোসেন কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখ বন্ধ। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই কফি বানাচ্ছে। শুভ্র বলল, বাবা, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে- তুমি খুব আনন্দিত। কোনো কারণ আছে?
মোতাহার হোসেন বললেন, কারণ আছে। বুদ্ধির খেলায় একজনকে হারিয়ে দিয়েছি। বুদ্ধিমান কাউকে বুদ্ধির খেলায় হারাতে পারলে সবার আনন্দ হয়। আমার একটু বেশি হয়।
শুভ্র বলল, বুদ্ধির খেলায় আমাকে হারাতে পারবে?
মোতাহার হোসেন কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, চেষ্টা করে দেখতে পারি।
শুভ্র বলল, তোমার সঙ্গে বুদ্ধির খেলা খেলতে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি হেরে গিয়ে মনে কষ্ট পাবে। কাউকে কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে না।
মোতাহার হোসেন বললেন, তুই এত নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছিস যে আমি হেরে যাব?
শুভ্র বাবার গায়ে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল, বাবা, আমার অনেক বুদ্ধি।
অনেক বুদ্ধি?
হ্যাঁ। বাবা, তুমি শুধু শুধু কফি খেয়ে আরাম পাচ্ছ না। এক কাজ কর সিগারেট ধরাও। সিগারেটের সঙ্গে কফি খাও।
মোতাহার হোসেন বললেন, তোর মা যদি দেখে তোর ঘরে বসে সিগারেট খেয়ে ঘর গান্ধা করে ফেলেছি, তাহলে খুব রাগ করবে।
শুভ্র বলল, মা দেখতে আসবে না। তাঁর মাথা ধরেছে। মা দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে।
মোতাহার হোসেন সিগারেট ধরালেন। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে হঠাৎ সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। অথচ চিন্তিত হবার মতো কিছু ঘটে নি।
জাহানারার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। এতক্ষণ এসি চলছিল। এসির শব্দে তার মাথার যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাচ্ছে দেখে এসি বন্ধ করা হয়েছে। ঘর অন্ধকার। বাথরুমে বাতি জ্বলিয়ে রাখা হয়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সেই আলো খানিকটা ঘরে আসছে। জাহানারা কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ঘুম আসছে না। জাহানারার মাথার কাছে সকিনা বসে আছে। সকিনার সামনে বড় একটা বাটিতে বরফ মেশানো পানি। সকিনা নিজের হাত সেই পানিতে ড়ুবিয়ে হাত ঠাণ্ডা করছে। সেই ঠাণ্ডা হাত দিয়ে জাহানারার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। জাহানারা পাশ ফিরলেন। বাথরুম থেকে আসা আলো তাকে কষ্ট দিচ্ছে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করলে হয়তো একটু আরাম লাগত। কিন্তু তিনি অন্ধকার সহ্য করতে পারেন না। ঘর অন্ধকার করলেই তার কাছে মনে হয় তিনি কবরে চলে গেছেন।
সকিনা!
জি মা।
শুভ্ৰ কি এখনো তার বাবার সঙ্গে গল্প করছে?
জি মা।
থাপ্পড় খাবে। তুমি তো আমার ঘরে বসে আছ। এখান থেকে বুঝলে কীভাবে? তুমি কি পীর-ফকির হয়ে গেছ? যাও দেখে এসে বলে।
সকিনা দেখে এসে বলল, এখন দুজন গল্প করছে।
জাহানারা বললেন, কী নিয়ে গল্প করছে?
সকিনা বলল, আমি শুনি নি মা। দেখেই চলে এসেছি। আড়াল থেকে শুনে আসব?
জাহানারা বললেন, দরকার নেই। তুমি আরো বেশিক্ষণ হাত পানিতে ড়ুবিয়ে রাখবে। হাত ঠাণ্ডা হচ্ছে না। গরম হাতে মাথা হাতীচ্ছ কেন?
সকিনা বলল, জ্বি আচ্ছা মা।
জাহানারা বললেন, তুমি কি জানো আমার ছেলে আমাকে পছন্দ করে না?
সকিনা বলল, এটা ঠিক না মা।
জাহানারা বললেন, মুখের উপর কথা বলবে না। আমি কী বলছি আগে শুনবে। হুটহাট কথা আমার পছন্দ না।
জি আচ্ছা।
আমার ছেলে যে আমাকে পছন্দ করে না- এটা আমার আজকের আবিষ্কার না। আমি টের পাই এক যুগ আগে। এক যুগ কী জানো?
জানি।
বলো এক যুগ কী?
বারো বছরে এক যুগ।
আমি বারো বছর আগে প্রথম টের পাই। শুভ্রর কাছে একটা কাক আসত। কাকটা হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করল। এতে শুভ্রর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি তখন শুভ্রর মন ভালো করার জন্যে তাকে একটা ময়না পাখি হালুয়াঘাট থেকে আনিয়ে দিলাম। ময়না পাখিটাকে আগেই কথা শেখানো হয়েছিল। সে বলত— এই শুভ্ৰ! এই। সুন্দর একটা খাঁচায় করে পাখিটা তাকে দিলাম। শুভ্র সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা পাখিটা ছেড়ে দিল।
সকিনা নিচু গলায় বলল, পাখিটাকে খাঁচায় বন্দি দেখে ভাইজান মনে কষ্ট পেয়েছিলেন।
জাহানারা বললেন, যা বোঝা না তা নিয়ে কথা বলবে না। পাখিটা আমি তাকে দিয়েছি বলেই সে ছেড়ে দিয়েছে। পাখিটা যদি তার বাবা দিত, তাহলে সে যত্ন করে রাখত।