সংবাদটা কী বলেন।
রহমতুল্লাহ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন— ম্যাডাম তোমাকে আজ রাতেই চলে যেতে বলেছেন। খাওয়া-দাওয়া কর, তারপর চলে যাও। তোমার কয়েক দিনের পাওনা বেতন আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। রাত এগারোটার সময় গোট বন্ধ হবে। গোট বন্ধ হবার আগে আগে চলে যাবে।
মনজু বিড়বিড় করে বলল, ভাইজানের সঙ্গে কি একবার দেখা করা যাবে?
রহমতুল্লাহ সিগারেটের ছাই টোকা দিয়ে ফেলতে ফেলতে কঠিন গলায় বললেন, না।
রুনুদের বাসায় রাতের খাবার নটার আগেই শেষ হয়ে যায়। ইকবাল সাহেব রাত সাড়ে দশটায় একটা ঘুমের ট্যাবলেট খান। ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যেতে নেই। ত্ৰিশ মিনিট অপেক্ষা করার নিয়ম। এই ত্ৰিশ মিনিট তিনি মেয়ের সঙ্গে গল্প করেন। গল্প করতে খুব ভালো লাগে। মেয়েটা মাঝে মাঝে মাথা ঝাকায়, তখন বেণী করা চুল মুখের উপর এসে পড়ে। এই দৃশ্যও দেখতে ভালো লাগে।
আজও রুনুর সঙ্গে গল্প করতে এসেছেন। গল্প জমছে না। রুনু চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছে। প্রশ্ন করলে কাটা কাটা জবাব দিচ্ছে। ইকবাল সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, তোর শরীর খারাপ না-কি রে?
রুনু বলল, না।
ইকবাল সাহেব বললেন, দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। চোখ লাল। দেখি কাছে আয়, কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা দেখি।
রুনু বলল, জ্বর দেখতে হবে না। আমার জ্বর আসে নি। শরীর ঠিক আছে।
তাহলে কি মন খারাপ?
মনও ঠিক আছে। আমার তোমাদের মতো হুটহাট করে মন খারাপ হয় না।
তোদের বেড়ানো কেমন হলো শুনি। মনজুর বসের ছেলে না-কি নিজেই আমাদের বাসায় এসেছিলেন? তোর মার কাছে শুনলাম ছেলে অসম্ভব ভদ্ৰ, অসম্ভব বিনয়ী। আবার না-কি খুবই সুন্দর?
রুনু বলল, বাবা, উনি ভদ্র হলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। অভদ্র হলেও আমাদের কিছু যায় আসে না।
ইকবাল সাহেব চিন্তিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে এরকম করছে কেন বুঝতে পারছেন না। তিনি আলাপ চালিয়ে যাবার জন্যে বললেন, তোরা সারাদিন কী করলি?
রুনু বলল, নৌকায় করে বুড়িগঙ্গায় ঘুরলাম। যেখানে নৌকাড়ুবি হয়ে ঘসেটি বেগম মারা গিয়েছিলেন, উনি সেই জায়গাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। খুঁজে পাওয়া গেল না।
ইকবাল সাহেব বললেন, ঘসেটি বেগমটা কে?
নবাব সিরাজদ্দৌলার খালা। বাবা শোন, আমার কথা বলতে ভালো লাগছে। না। তোমার আধাঘণ্টা নিশ্চয় পার হয়েছে। ঘুমুতে যাও।
তুই কী করবি?
আমি পড়াশোনা করব। আজ সারারাত পড়ব। দিনে বেড়াতে গিয়ে যে সময়টা নষ্ট করেছি, সেটা কাভার করব।
ভোরে উঠে পড়াশোনা করা ভালো। রাতের ঘুমের পর ব্রেইন রেষ্টে থাকে। সকালবেলার পড়াটা মনে থাকে। আমি সারাজীবন এইভাবে পড়েছি।
রুনু বিরক্ত গলায় বলল, তুমি সারাজীবন এইভাবে পড়ে তেমন কিছু করতে পার নি বাবা। মেট্রিকে সেকেন্ড ডিভিশন, ইন্টারমিডিয়েটে সেকেন্ড ডিভিশন, বিএতে থার্ড ক্লাস। আর আমাকে দেখা- আমি আমার মতো পড়াশোনা করে মেট্রিকে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে থার্ড হয়েছি। ইন্টারমিডিয়েটে আরো ভালো করব।
ইকবাল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, অহঙ্কার করা ঠিক না মা। আল্লাহপাক যে অহঙ্কার করে তাকে পছন্দ করেন না। এই বিষয়ে রসুলুল্লাহর একটা হাদিস আছে। নবী-এ-করিম বলেছেন…
রুনু বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার এখন হাদিস শুনতে ইচ্ছা করছে। না। আর আমি অহঙ্কার করেও কিছু বলি নি। তোমার কথাবার্তা শুনে রাগ করে বলেছি।
রাগ করার মতো কী বললাম?
বাবা তুমি ঘুমুতে যাও। প্লিজ। আমি এখন পড়াশোনা শুরু করব।
ইকবাল সাহেব মন খারাপ করে উঠে পড়লেন। মেয়ের সঙ্গে ত্ৰিশ মিনিট সময় তার খুব ভালো কাটে। আজ রুনুর কী হয়েছে কে জানে! একবার মাথা পর্যন্ত ঝাকায় নি।
শায়লা ফ্রাক্স ভর্তি চা এনে মেয়ের টেবিলে রাখলেন। আইসক্রিমের খালি প্লাস্টিকের বাক্সে কয়েকটা পাতলা রুটি। রুনুর স্বভাব হচ্ছে, রাত জেগে বই হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়বে। মাঝে মাঝে চায়ে ভিজিয়ে রুটি খাবে। রাত জেগে পড়লে তার খুব ক্ষিধে পায়।
ভালো না? তোর বাবা বলছিলেন।
রুনু বলল, মেজাজ ঠিক আছে।
শায়লা বললেন, নৌকাভ্রমণে আজ তোরা কী কী করলি শুনি।
রুনু বলল, কয়েকবার তো শুনেছ।
শায়লা বললেন, আমি কই শুনলাম?
রুনু বলল, কী শুনতে চাও জিজ্ঞেস করো, আমি এক এক করে বলছি।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া কোথায় করলি?
মনজু ভাই প্যাকেটে করে খাওয়া নিয়ে গিয়েছিলেন।
কী খাওয়া?
জানি না। কী খাওয়া। মনে নেই।
শায়লা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে जा6छ।
শায়লা বললেন, তুই রেগে আছিস কেন রে মা?
রুনু হতাশ গলায় বলল, আমি কেন রেগে আছি নিজেও জানি না।
শায়লা বললেন, তোর তো অনেক বুদ্ধি। তুই না জানলে কে জানবে?
রুনু বলল, আমার রাগ উঠেছে মনজু ভাইয়ের উপর।
শায়লা বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কী করেছে?
রুনু বলল, তার বসের ছেলের দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণ তেলতেলা হাসি দিয়েছে। চাকরটাইপ হাসি। চাকরি নিয়ে সে বড় বড় কথা বলে, আমার ধারণা তার আসল চাকরি হলো, সে বসের ছেলের অ্যাসিসটেন্ট। জুতা ব্রাশ করে দেয়। ব্যাগে করে তার জন্যে পানির বোতল নিয়ে পেছনে পেছনে হাটে। রোদে বের হলে মাথায় ছাতা ধরে।
শায়লা বললেন, চুপ কর তো!
রুনু বলল, আচ্ছা যাও, চুপ করলাম। মা শোন, মনজু ভাইয়ের সঙ্গে তুমি আমার বিয়ে দেবার পায়তারা করছি— এটা দয়া করে করবে না। আমি চাকর শ্রেণীর কাউকে বিয়ে করব না। বিয়ে যে করতেই হবে এমন তো কথা না। আমি ঠিক করেছি। বিয়েই করব না।