মনজু বালিশের নিচ থেকে সিগারেট ধরাল। খালি পেটে সিগারেট ধরালে মাথা ধরা আরো বাড়বে। বাড়ুক। মাথার যন্ত্রণায় সে ছটফট করুক। মাথা যন্ত্রণা নিয়ে মার চিঠির জবাব দিতে পারলে ভালো হতো। মনজু সিগারেটে টান দিয়ে মনে মনে চিঠির জবাব দিতে শুরু করল–
মা, তোমার চিঠি পেয়েছি। সন্ত্রাসী হাতকাটা জহিরুলকে আমার অভিনন্দন পৌছে দেবার ব্যবস্থা করবে। সে যে আমার সৎপিতার বাম হাতের কজি কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতে আমি আনন্দিত। বাম হাতের কজি না কেটে ডান হাতেরটা কাটা কি সম্ভব? এই বিষয়ে তুমি তার সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে পার। আমার ধারণা অনুরোধ করলে সে রাখবে। তোমার অনুরোধ তো সে ফেলবেই না। তোমার মতো মিষ্টি করে অনুরোধ কেউ করতে পারে বলে আমি মনে করি না। একটাই শুধু আফসোস— আমার আসল বাবার সঙ্গে তোমার মিষ্টি গলা কখনো বের কর নি।
মা, তোমার কি মনে আছে বাবা তার কোনো এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে গিয়ে দেরি করে ফিরেছিল বলে তুমি তাকে শাস্তি দিয়েছিলে? পৌষ মাসের প্রচণ্ড শীতে তুমি দরজা খুলো নি। বেচারাকে সারারাত বাইরে বসে থাকতে হয়েছে। যাই হোক, কী আর করা! প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের কপাল নিয়ে আসে। আমার সৎবাবা ভালো কপাল নিয়ে এসেছেন।
মা, উনার কব্জি কাটা নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইও না। প্রতিটি খারাপ জিনিসের মধ্যেও ভালো কিছু থাকে। উনার কজি কাটায় নিশ্চয়ই কোনো মঙ্গল নিহিত আছে। আমরা সেটা ধরতে পারছি না।
এই মুহূর্তে আমার যেটা মাথায় আসছে তা হলো— ভিক্ষাবৃত্তিতে সুবিধা। শেষ জীবনে উনাকে যদি ভিক্ষা করে খেতে হয় তাহলে কজি কাটা খুবই কাজে আসবে। মানুষের দয়া আকর্ষণের জন্যে কাটা কজি কাজে আসবে। রোজ সকালে একটা থালা হাতে তুমি উনাকে মসজিদের পাশে বসিয়ে দিয়ে আসবে। এশার নামাজের পর নিয়ে আসবে। বুদ্ধিটা ভালো না?
আমার খবর হচ্ছে- আমি ভালো আছি। চাকরিতে অতি দ্রুত একটা প্রমোশন হয়েছে। এখন আমি একটা সেকশনের ইনচার্জ। বেতন সব মিলিয়ে পনের হাজার পাচ্ছি। তারপরেও আমার পক্ষে তোমাদের কোনো টাকা-পয়সা পাঠানো সম্ভব না। কারণ আমি বিয়ে করছি। বিয়ের খরচ তো আমাকে কেউ দিবে না। নিজেকেই জোগাড় করতে হবে। মেয়ের নাম রুনু। তুমি চিনতেও পার— ইকবাল মামার মেয়ে। বিয়ের পর হানিমুন করতে নেপাল যাব। সেখানেও টাকা দরকার। আগামী এক-দুই বছর একটা টাকাও তোমাদের পাঠাতে পারব না।
আসলে তোমার গর্ভই খারাপ। গর্ভে যেমন বিছু-মেয়ে ধারণ করেছ, সে-রকম কুলাঙ্গার ছেলেও ধারণ করেছ। কজিকাটা মানুষটাকে নিয়ে সুখে দিন কাটাও— এই তোমার প্রতি আমার শুভকামনা।
ইতি
তোমার কুপুত্র মনজু
মনে মনে চিঠিটা লিখে মনজু আরাম পেয়েছে। এরকম আরেকটা চিঠি সৎবাবাকে লিখতে পারলে আরামটা আরো প্রবল হতো। চিঠির শুরু হবে এইভাবে–
ঐ ব্যাটা কব্জিকাটা, ….
শুরুটাতে কবিতার ছন্দের মতো ছন্দ আছে। মিলও আছে। ব্যাটার সঙ্গে কাটার মিল।
চিঠিটা শুরু করা গেল না।
রহমতুল্লাহ এসে ঢুকল। তার পরনে ইস্ত্রি করা পায়জামা-পাঞ্জাবি। চুল আঁচড়ানো। মুখ দিয়ে মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। আজ তার বিশেষ দিন। মদ্যপান করেছেন। যেদিন এই কাজটা করেন সেদিন তার সাজগোজ ভালো থাকে। মেজাজও ভালো থাকে। তিনি মনজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আছ কেমন?
মনজু বলল, ভালো।
খাওয়া-দাওয়া করেছি?
জি-না।
খাওয়া-দাওয়া করে নাও। আজ ভালো খাওয়া আছে। মেজবানির গরুর মাংস। হেড অফিসে রান্না হয়েছে। চিটাগাং থেকে বাবুর্চি এসেছে। মেজবানির মাংস গরম গরম খাওয়া ভালো।
মনজু বলল, আজ কি কোনো উপলক্ষ?
রহমতুল্লাহ হাই তুলতে তুলতে বললেন, আছে নিশ্চয়ই কিছু। হেড অফিসের সব খবর তো পাই না। আমি পচা আদার ব্যাপারি। জাহাজের খবর কী রাখব? হেড অফিস হলো জাহাজ। এইটাই ভাবতেছিলাম– আমাদের বড় সাহেব ঢাকা শহরে এসেছিলেন এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে। তার কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগে ছিল একটা লুঙি আর একটা পাঞ্জাবি। সঙ্গে ছিল ক্যাশ আটশ পচিশ টাকা। টাকাটা এনেছিলেন মায়ের গলার চেইন বিক্রি করে। আর দেখ আজ তার অবস্থা। শুনেছি বড় সাহেব না-কি আস্ত একটা দ্বীপ কিনবেন। একটা কেন, চার-পাঁচটা দ্বীপ কেনাও তার কাছে কোনো বিষয় না।
মনজু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। রহমতুল্লাহ বললেন, পাক কোরান মজিদে একটা আয়াত আছে, সেখানে আল্লাহপাক বলেছেন– আমি যাহাকে দেই তাহাকে কোনো হিসাব ছাড়াই দেই। আবার যাহাকে দেই না। তাহাকে কিছুই দেই না। ইহা আমার ইচ্ছা। নাপাক মুখে কোরান মজিদের আয়াত বলেছি, বিরাট গুনাহর কাজ করেছি। আল্লাহগো, বান্দাকে মাফ করা। মনজু, তোমার কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা সিগারেট দাও। নেশার সময় সিগারেটটা ভালো লাগে।
মনজু সিগারেট দিল। রহমতুল্লাহ আয়েশ করে সিগারেটে টান দিয়ে বললেন- আল্লাহপাক যে বলেছেন যাহাকে দেই না তাহাকে কিছুই দেই না— এটা অতি সত্যি কথা। তোমার আমার কথাই বিবেচনা কর। সত্যি না?
মনজু বলল, জ্বি সত্যি।
মাতালের জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে ভালো লাগছে না। তারপরেও শুনতে হবে। মাতালরা অন্যের কথা শুনতে চায় না। নিজের কথা বলতে চায়। মনজু!
জি।
তোমার জন্যে একটা সংবাদ আছে। সংবাদটা ভালো না মন্দ বুঝতে পারছি না। অনেক মন্দ সংবাদও সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় সংবাদটা আসলে মন্দ না, ভালো। আবার অনেক ভালো সংবাদ ঠিকমতো বিবেচনা…।