জাহানারা কঠিন মুখে বললেন, এত রাতে তাকে খবর পাঠানো যাবে না। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অস্থির হবার কিছু নাই।
কোনো বিষয়ই তুচ্ছ না মা।
জাহানারা উঠে দাঁড়ালেন। তার ঘাড়ের ব্যাথা আবার শুরু হয়েছে। হাতের তালু ঘামছে। তার উচিত ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকা। সেটা সম্ভব না। আগে তাকে দুটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনজু নামের বদমাশটাকে বিদায় করতে হবে। সকিনাকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। কাজটা করতে হবে। আজ রাতেই। শুভ্রর বাবার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। জাপানি কোনো এক কোম্পানির ডিরেক্টরের সঙ্গে আজ তার ডিনার আছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।
মনজু বিছানায় শুয়ে আছে। তার হাতে মায়ের চিঠি। চিঠিটা আজ দুপুরে এসেছে। এখনো পড়া হয় নি। মায়ের চিঠি এমন কোনো ব্যাপার না যে বিছানায় শুয়ে আয়েশ করে পড়তে হবে। মনজুর খুবই ক্লান্তি লাগছে- বসে থাকতে পারছে না। আজ সারা দিন তার উপর ভালো ধকল গিয়েছে। রুনুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বড় রকমের ভুল হয়েছে। মেয়েটা ফেরার পথে একটু পরপর চোখ মুছছিল। চোখের পানি ফেলার মতো কোনো ঘটনা তো ঘটে নি। শুভ্ৰ ভাইজান তার স্বভাবমতো রুনুর সঙ্গে অতি ভদ্র ব্যবহার করেছেন। রুনু কি তার অতি ভদ্র ব্যবহারকেই অন্য কিছু ভেবেছে? এত বোকা মেয়ে তো রুনু না।
মনজু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মার চিঠি পড়তে শুরু করল। চিঠি পড়ার আগেই তার মন ভারী হয়ে গেল। দীর্ঘ চিঠিতে আনন্দ পাওয়ার মতো কিছুই থাকবে না। মার চিঠি মানেই ধারাবাহিক ঘ্যানঘ্যাননি।
বাবা মনজু,
দোয়া পরসমাচার তোমার পাঠানো টাকা পাইয়াছি। মাত্র চার হাজার টাকা পাঠাইয়াছ কেন বুঝিলাম না। তুমি জানাইয়াছিলে তোমার বেতন ছয় হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া ফ্রি। সেই ক্ষেত্রে ইচ্ছা করিলেই তুমি আরো কিছু পাঠাইতে পারিতে। সংসারের অবস্থা অতি শোচনীয়। বাবা, তুমি যেভাবেই পার প্রয়োজনে ঋণ করিয়া হইলেও দুই একদিনের ভিতর আরো দুই হাজার টাকা পাঠাও। নিতান্তই অপারগ। হইয়া তোমাকে জানাইতেছি।
মূল ঘটনা না জানিলে তুমি বিপদের মাত্রা বুঝিতে পরিবে না। তোমার সৎবাবার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। তিনি আবার ভালো সিগারেট ছাড়া খাইতে পারেন না। পুরানা দিনের অভ্যাস। তিনি একটা দোকান থেকে বাকিতে সিগারেট নিতেন। সেখানে একুশ শ টাকা বাকি পড়িয়া গেল। দোকানদারের এক ভাই আছে মাস্তান। নাম জহিরুল। অঞ্চলে হাতকাটা জহিরুল নামে তার পরিচয়। সকলেই তার ভয়ে অস্থির থাকে। থানায় তার নামে কয়েকটি মামলা আছে। তারপরও থানাওয়ালারা তাহাকে কিছুই বলে না। উল্টা খাতির করে। চা-সিগ্রেট খাওয়ায়। ঐ বদমায়েশ হাতকাটা জহিরুল অনেক লোকজনের সামনে তোমার সৎবাবার শার্টের কলার চাপিয়া ধরিয়াছে। চড়-থাপ্নড় দিয়াছে। সে তোমার সৎবাবাকে বলিয়াছে— এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানের বাকি শোধ না করিলে সে তোমার সৎবাবার বাম হাতের কজি কাটিয়া ফেলিবে।
বাবা মনজু, হাতকাটা জহিরুলের পক্ষে সবই সম্ভব। তোমার সৎবাবা ভয়ে দিনরাত এখন ঘরে থাকেন। তাহার রাতে ঘুম হয় না। বাবা, এই বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা তোমাকে যেভাবেই হউক। করিতে হইবে।
তোমার বোনের হাতে কিছু টাকা আছে। পরিমাণ কত আমি জানি না। সে এই বিষয়ে কিছুই বলে না। গত মঙ্গলবার চায়ের পাতা কিনিবার জন্যে তাহার নিকট পঞ্চাশটা টাকা চাহিয়াছি। সে বলিল, টাকা নাই। অথচ সেই দিনই সন্ধ্যায় সে জিলাপি কিনিয়া আনিয়া তাহার দুই পুত্রকে খাওয়াইছে। আমার মনে খুবই দুঃখ হইয়াছে। আমি কেমন সন্তান গর্ভে ধারণা করিয়াছি যে আমার সহিত মিথ্যাচার করে?
আরেক দিনের ঘটনা শুনিলে তুমি অবাক হইবে। তোমার সৎবাবা বাজার হইতে শখ করিয়া একটা কালো বাউস মাছ কিনিয়া আনিয়াছেন। দুপুরে খাইতে তাহার বিলম্ব হয়। কারণ তিনি এই সময় স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়িতে যান। দুপুরের দিকে লাইব্রেরিতে ভিড় থাকে না। সব পত্রিকা হাতের কাছে পাওয়া যায়। উনার ফিরিতে বিলম্ব হইবে জানি বলিয়া আমি একটা বাটিতে কয়েক পিস মাছ তুলিয়া মিটাসেফে রাখিয়া গোসল করিতে ঢুকিয়াছি, এই ফাকে তোমার ভগ্নি বাটির সবগুলি মাছ তাহার দুই পুত্রকে খাওয়াইয়া দিয়াছে। যে শাখা করিয়া মাছ কিনিয়াছে তাহার ভাগ্যে মাছের একটা ভালো পিস জুটে নাই। ইহাকে শক্ৰতা ছাড়া আর কী বলা যায়! নিজের পেটের সন্তান যদি শত্রু হয় তখন বুঝিতে হইবে কিয়ামতের আর দেরি নাই।
বাবাগো, সংসারের এইসব বিষয় নিয়া মন খারাপ করিও না। সবই আমার কপাল। এখন তুমি শুধু তোমার সৎবাবাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করা। তুমি জানো না যে তিনি তোমাকে কী পরিমাণ স্নেহ করেন। প্রায়শই তোমার কথা বলেন। বাবাগো, পত্রপাঠ শেষ হইবা মাত্ৰ তুমি মানি অর্ডার যোগে টাকা পাঠাইবার ব্যবস্থা কর।
ইতি
তোমার মা
চিঠি পড়তে গিয়ে মনজুর মাথা ধরে গেছে। মাথা ধরা সারানোর উপায় হলো, গরম পানি নিয়ে হেভি গোসল দেয়া। গোসলের পর কড়া এক কাপ চা। সঙ্গে মামা-ভাগ্নে সিগারেট। বাড়িতে টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারলে মাথা ধরা সঙ্গে সঙ্গে কমে যেত। এই সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। হাতে টাকা আছে মোট চারশ এগারো। এক জোড়া জুতা আর একটা হালকা সবুজ রঙের। হাফ শার্ট কিনে সে টাকা নষ্ট করেছে। জুতা জোড়া কিনতেই হতো। শার্টটা না। কিনলেও চলত। শার্টটা কেনা হয়েছে লোভে পড়ে। শার্টটা এখনো পরা হয় নি। দোকানে নিয়ে গেলে টাকা ফেরত দেবে বলে মনে হয় না। টাকা। এমন জিনিস যে হাত থেকে বের হলে আর ফেরত আসে না।