রুনু বলল, আপনাকে উদ্ধারের জন্য এক লক্ষ টাকা পুরস্কার কে পেয়েছিল?
শুভ্র বলল, আমি জানি না কে পেয়েছিল। আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
আপনাকে জানতে হবে না।
অবশ্যই জানতে হবে। একটা বিষয়ে তোমার কৌতূহল হয়েছে, তুমি সেটা জানবে না?
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। এক পাশে সূর্য এখনো দেখা যাচ্ছে কিন্তু সূর্যে তাপ নেই। মনজু চিন্তিত মুখে আকাশ দেখছে। সে বলল, ভাইজান, এখন ফিরি? বৃষ্টি নামবে।
শুভ্র বলল, নামুক। বৃষ্টি নামলে বৃষ্টিতে ভিজব। রুনু, তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে আপত্তি আছে?
রুনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।
শুভ্র লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার দৃষ্টি এখন আকাশে। মেঘের উপর মেঘ জমার দৃশ্যটা যে এত সুন্দর তা সে আগে লক্ষ করে নি। আজ রাতে আত্রলিতাকে এই দৃশ্যের কথা জানাতে হবে। কীভাবে লিখবে এটা গুছিয়ে ফেললে কেমন হয়?
আত্রলিতা! আজ কিছুক্ষণের জন্যে নৌকাভ্রমণ করেছি। আমি নৌকার পাটাতনে শুয়েছিলাম। নৌকা দুলছিল। নৌকার দুলুনির সঙ্গে আশেপাশের সব দৃশ্য দুলছে। শুধু দুলছে না মাথার উপরের ঘন কালো মেঘ। প্রকৃতির একটি অংশ দুলছে, আরেকটি অংশ স্থির। খুবই অদ্ভুত।
রুনুর কেমন জানি লাগছে। এক ধরনের অস্বস্তি, এক ধরনের কষ্ট। মানুষটা এতক্ষণ তার সঙ্গে কত কথা বলছিল, এখন কেমন ঘোরলাগা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে চোখের সামনে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
মানুষটা শুয়ে আছে নৌকার পাটাতনে। শোয়ার ভঙ্গিটাও কী সুন্দর। এত মন দিয়ে দেখার মতো কী আছে আকাশে? রুনুর এখন খুব একটা বাজে ইচ্ছা হচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে মানুষটার পাশে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সে নিশ্চয়ই খুব খারাপ একটা মেয়ে। এরকম চিন্তা খারাপ মেয়ে ছাড়া কারোর মাথায় আসবে না। সে অবশ্যই খারাপ মেয়ে। ভয়ঙ্কর খারাপ মেয়ে।
রুনুর কান্না পাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে কান্না আটকে রাখতে। কতক্ষণ পারবে কে জানে! মনজু ভাই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে যদি কাঁদতে শুরু করে তাহলে মনজু ভাই কী ভাববেন কে জানে!
শুভ্ৰ হঠাৎ রুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, রুনু, একটা কাজ কর। আমি যেভাবে শুয়ে আছি ঠিক এইভাবে শুয়ে আকাশের দিকে তাকাও। অদ্ভুত একটা ফিলিং হবে। মনে হবে মেঘের সঙ্গে সঙ্গে তুমিও ভাসছ।
রুনু সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। সে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। কিন্তু সে মেঘ দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তার চোখ ভর্তি জল। আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে তার কাঁদতে ভালো লাগছে।
তালতলার পীর সাহেবের নাম কামাল উদ্দিন কাশেমপুরী। পীর সাহেব ছোটখাটো মানুষ। গলার স্বর মধুর। তিনি সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলেন। তাঁর ছোট ভাই জামাল উদ্দিন কাশেমপুরীও পীর ছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল কৰ্কশ। মুরিদানদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারও ছিল খারাপ। এমনও শোনা যায় তিনি কোনো মুরিদানের উপর রাগ করে লাথি মেরেছেন। দুই ভাই দুই তরিকার পীর। একজন গরম পীর, একজন নরম পীর। বছর ছয়েক আগে ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। তার মুরিদানরা বড় ভাইয়ের কাছে ছুটে এসেছে। বড় ভাই হাসিমুখে বলেছেন, বাবারা, তোমরা আমার কাছে এসো না। আমার ভাইয়ের পথ আর আমার পথ এক না। এক পুকুরেই আমরা অজু করি। কিন্তু আমাদের ঘাট ভিন্ন।
জাহানারা পীর সাহেবের সামনে ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। পীর সাহেব বললেন, মাগো, বাম হাতটা একটু বাড়ান।
জাহানারা হাত বাড়ালেন। পীর সাহেব জাহানারার হাতে আন্তর মাখিয়ে দিলেন। জাহানারা বললেন, বাবা আমার জন্যে দোয়া করবেন, আমি খুবই কষ্টে আছি।
পীর সাহেব বললেন, কেউ যখন আমাকে বলে আমি কষ্টে আছি তখন বড় আনন্দ হয় গো মা। কারণ আল্লাহপাক তার পিয়ারাবান্দাদের কষ্টে রাখেন। তিনি যাদের উপর নাখোশ তারাই ইহকালে সুখে থাকে। আপনার মাথাব্যথা রোগের কি কিছু আরাম হয়েছে?
জি-না।
চোখে সুরমা দিবেন। সুরমা দিয়ে জায়নামাজে বসে বলবেন– হে আল্লাহপাক, তুমি আমাকে রোগ দিয়েছ। এই রোগ নিয়াও আমি সবুর করলাম। এই রোগই আমার বান্ধব। খাস দিলে এটা বলতে পারলে আল্লাহপাক রোগ তুলে নিবেন।
জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি খাস দিলে কিছুই বলতে পারি না বাবা। আমার মন সবসময় অস্থির থাকে। ছেলে সকালবেলা বের হয়েছে, এখনো ফিরে নাই। কোথায় গিয়েছে কিছুই জানি না। ড্রাইভার বদমাশটা মোবাইল টেলিফোন বন্ধ করে রেখেছে।
পীর সাহেব কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলেন। তারপর চোখ মেলে বললেন, ছেলে বাড়িতে ফিরেছে গো মা। টেলিফোন করে দেখেন। আর যদি নাও ফিরে–কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবে। ধ্যানে পেয়েছি।
জাহানার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল। সকিনা। সে জানাল, শুভ্ৰ ভাইজান কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। তার সারা শরীর ভেজা। চোখ লাল। মনে হয় জ্বর এসেছে।
জাহানারা বললেন, ডাক্তার খবর দিয়েছ?
সকিনা বলল, দিয়েছি মা।
জাহানারা বললেন, ওর জ্বর কত থার্মোমিটার দিয়ে এক্ষুণি আমাকে জানাও। আমার ফিরতে দেরি হবে, আমি পীর সাহেবের কাছে আছি।
জি আচ্ছা।
তোমাকে তো আমি চলে যেতে বলেছিলাম, তুমি চলে যাও নি কেন?
কাল সকালে যাব। মা।
অবশ্যই সকালে বিদায় হবে। আমি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে যেন তোমাকে দেখতে না পাই।… আমি টেলিফোন ধরে আছি। তুমি শুভ্রর জ্বর কত সেটা থার্মোমিটারে দেখে আমাকে জানাও।