জাহানারা বিরক্ত গলায় বললেন, এইসব আজগুবি কথা আমাকে শুনাবে না। গাছের কাছে চাইলেই গাছ দিয়ে দেবে। গাছ কি পীর সাহেব না-কি?
সকিনা বলল, বহুকাল আগে এক সাধু কুমিরের পিঠে চড়ে আমাদের অঞ্চলে এসেছিলেন। উনি নিজের হাতে এই গাছ লাগিয়েছিলেন।
জাহানারা বললেন, তোমাকে না বললাম আজগুবি গল্প বন্ধ করতে। কুমিরের পিঠে চড়ে তাকে আসতে হলো কেন? তখন কি দেশে নৌকা ছিল না?
সকিনা বলল, শুভ্ৰ ভাইজান তো গাছ দেখতে যাবেন– তখন আপনি যদি যান।
জাহানারা বিছানা থেকে উঠে বসতে বসতে বললেন, শুভ্র গাছ দেখতে যাবে মানে কী?
সকিনা বলল, উনি বলেছেন যাবেন। এই বর্ষার মধ্যেই যাবেন।
শুভ্রকে গাছের হাবিজাবি কথা তুমি বলেছ? কখন বলেছ? খাতিরের এত আলাপ করার সময়টা বলো।
সকিনা চুপ করে গেল। জাহানারা বললেন, তুমি তলে তলে অনেকদূর চলে গেছ। সুড়ঙ্গ কেটে যাওয়া। এখন বলো, শুভ্ৰ কি কখনো তোমার ঘরে গিয়েছে?
সকিনা বলল, উনি আমার ঘরে কেন যাবেন?
জাহানারা বললেন, প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে দিবে না। ও তোমার ঘরে গিয়েছে, না-কি যায় নি?
জাহানারার চোখ চকচক করছে। ঠোট কালো হয়ে আসছে। সকিনা ভীত গলায় বলল, মা, আপনি খুব ভালো করে জানেন ভাইজান এরকম মানুষ না।
জাহানারা চাপা গলায় বললেন, শোন সকিনা, মাকাল ফলের ভেতর পোকা হয় না। পোকা হয় সবচে ভালো যে ফল তার মধ্যে— আমের মধ্যে। বুঝেছ? শুভ্ৰ মাকাল ফল না।
সকিনা বলল, মা আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার শরীর কাঁপছে।
জাহানারা বললেন, অচিনবৃক্ষের কথা শুভ্রর সঙ্গে কখন হয়েছে সেটা বলে। কখন হয়েছে? কোথায় হয়েছে?
উনার ঘরে। সন্ধ্যাবেলায়।
জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, কথা বলার সময় তুমি কি ইচ্ছা করে শাড়ির আঁচল ফেলে দিয়েছ বুক দেখানোর জন্যে? চুপ করে থাকবে না— বলো। আমার ছেলেকে ভুলানোর জন্যে কী কী কৌশল করেছ সেটা বলো। বুক দেখানো ছাড়া আর কী করেছ?
মা, কেন এরকম করছেন?
চুপ থাক মাগি! মা ডাকবি না। তুই এক্ষুণি এই মুহুর্তে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি।
সকিনা বলল, ঠিক আছে মা— চলে যাব।
চলে যাব বলেও বসে আছিস কেন?
সকিনা উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বের হলো। জাহানারা কাঁদতে শুরু করলেন।
রুনু অবাক হয়ে শুভ্রকে দেখছে। একটি যুবক ছেলের দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকা যায় না। অস্বস্তি লাগে। রুনুর অস্বস্তি লাগছে না। বরং তার মনে হচ্ছে এইভাবে তাকিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। রুনু বের করার চেষ্টা করছে কেন তার অস্বস্তি লাগছে না। তার ধারণা তার অস্বস্তি লাগছে না। কারণ যার দিকে সে তাকিয়ে আছে তার অস্বস্তি লাগছে না। একজন পাগলের দিকে একদৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা যায়, কারণ পাগল তাতে কিছু মনে করে না। বাচ্চা একটা ছেলের দিকেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়।
রুনু বসে আছে ইঞ্জিন বসানো ছোট্ট একটা নৌকার পাটাতনে। পাটাতনে শীতলপার্টি বিছানো। শুভ্ৰ পা ছড়িয়ে হাতে ভর দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আধশোয়া হয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির না। সে সব কিছুর উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে হাসিমুখে তাকাচ্ছে রুনুর দিকে। মনজু বসেছে মাঝির কাছে। নৌকায় অল্প অল্প পানি উঠছে। মনজু অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে সেই পানি তুলে নদীতে ফেলছে।
শুভ্র রুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যে পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছ তার জন্যে ধন্যবাদ। এখন বলো— তোমার কি ভালো লাগছে?
রুনু বলল, ভালো লাগছে।
শুভ্ৰ আধশোয়া অবস্থা থেকে বসতে বসতে বলল, কোন জিনিসটা ভালো লাগছে বলো তো। স্পেসিফিক্যালি বলো।
রুনু কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই অদ্ভুত সুন্দর ছেলেমানুষ ধরনের যুবক তার কাছে কী শুনতে চাচ্ছে? সে যা শুনতে চায়। রুনু তাকে তাই বলবে।
শুভ্র বলল, চুপ করে আছ কেন বলো? এখানে ভালো লাগার অনেকগুলি এলিমেন্ট আছে। একটা হচ্ছে নদী, একটা হচ্ছে আকাশ, একটা হচ্ছে নদীর নানান কর্মকাণ্ড…।
রুনু বলল, সবকিছু মিলিয়েই আমার ভালো লাগছে।
শুভ্র বলল, তোমার কি এরকম মনে হচ্ছে যে সবচে ভালো হয় যদি আর বাড়িতে ফিরে না যাওয়া যেত? নৌকা চলছে তো চলছেই। আমরা নৌকার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি।
রুনু সামান্য চমকালো। নৌকায় উঠার পর থেকেই তার এরকম মনে হচ্ছে। শুভ্র বলল, বাড়ি থেকে বের হলে আমার আর বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছা করে না। দশ-এগারো বছর বয়সে আমি একবার বাড়ি থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
রুনু ক্ষীণ গলায় বলল, কেন?
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, মনের দুঃখে। আমার একটা পোষা কাক ছিল। কাকটা রোজ আসত আমার কাছে। হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করল। খুব কষ্ট লাগল। আমি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম কাকটাকে খুঁজে বের করতে।
পোষা কাক মানে?
কাকটা পোষ মেনেছিল। আমি তার নাম দিয়েছিলাম কিংকর।
কাকটাকে পেয়েছিলেন?
না। আমি সকালবেলা বের হয়েছিলাম, সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজলাম।
কীভাবে খুঁজলেন?
যেখানে কাক দেখতাম দাঁড়িয়ে পড়তাম। আমার ধারণা ছিল আমি কাকটাকে চিনতে না পারলেও সে আমাকে চিনবে। আমাকে দেখলেই উড়ে আসবে আমার কাছে।
আপনি কী করলেন? সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে এলেন?
না। তোমাকে বলেছি না একবার বাড়ি থেকে বের হলে আমার আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। আমি ফিরলাম তিনদিন পরে। ফিরলাম বলা ঠিক হবে না। পুলিশ তিনদিন পর আমাকে মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্ধার করল। আমাকে উদ্ধারের জন্যে বাবা এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। আমার মা এই তিনদিন পানি ছাড়া কিছু খান নি। ঐ ঘটনার পর আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রাইভেট মাস্টাররা বাড়িতে এসে আমাকে পড়াত।