আমি টেনশান করব না? ঢাকা শহরে রোজ কয়টা রোড এক্সিডেন্ট হয় তুমি জানো?
না জানি না।
ইররেসপনসিবল একটা ড্রাইভার! ও নিৰ্ঘাৎ কোনো ট্রাকের সঙ্গে গাড়ি লাগিয়ে দেবে। অটোমেটিক গাড়ি, কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হলে দরজা-জানালা লক হয়ে যাবে। দরজা না কেটে শুভ্ৰকে বের করা যাবে না।
কী বলছি। এসব?
জাহানারা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি কাল রাতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। এই জন্যেই এত টেনশন করছি।
ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন তো তুমি প্রতিরাতেই দেখ।
কাল রাতের মতো ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কম দেখি। কাল রাতে কী স্বপ্ন দেখেছি শোন। স্বপ্ন বলা ঠিক না, তারপরেও বলছি।
মোতাহার হোসেন বললেন, বাসায় এসে শুনব। টেলিফোনে স্বপ্ন শুনে মজা পাওয়া যায় না।
জাহানারা কঠিন গলায় বললেন, আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নের আবার মজা কী! কাল রাতে স্বপ্নে আমি প্ৰকাণ্ড একটা কালো রঙের হাতি দেখেছি।
হাতি কি তোমাকে কিছু করেছে?
না, কিছু করে নি। হাতির গলায় ঘণ্টা বাধা। ঘণ্টা বাজিয়ে হাতি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।
এটা তো তেমন দুঃস্বপ্ন বলে আমার মনে হচ্ছে না।
তুমি এই বিষয়ে কিছু জানো না বলে এরকম বলতে পারলে। সাদা হাতি দেখা ভালো। সাদা হাতি দেখলে ধন লাভ হয়। কালো হাতি দেখার মানে অতি প্রিয়জনের মৃত্যু।
মোতাহার হোসেন হতাশ গলায় বললেন, মৃত্যু ঠেকানোর উপায় কী?
জাহানারা বললেন, আজ সন্ধ্যায় আমি তালতলার পীর সাহেবের কাছে যাব। উনার দোয়া নেব।
বেশ তো যাও।
তুমি উনার কাছে খবর পাঠাও যে আজ আমি যাব। উনি সপ্তাহে দুদিন হুজরাখানায় বসেন। তখন কেউ তাকে ডিসটর্ব করতে পারে না। আজ হলো সেই দুদিনের একদিন। আগে খবর না দেয়া থাকলে উনি হুজরাখানায় বসে পড়বেন।
খবর পাঠাচ্ছি।
দ্বীপ কি কেনা হয়েছে?
দ্বীপ কেনা হয়েছে মানে কী?
জাহানারা হতাশ গলায় বললেন, তোমাকে বললাম না ছোট্ট একটা দ্বীপ কিনে দিতে? আমার কোনো একটা কথাও কি তুমি মন দিয়ে শোন না?
মোতাহার হোসেন বিরক্ত গলায় বললেন, কাঁদছ কেন?
জাহানারা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, কাঁদব না তো কী করব? আনন্দে নাচব? খুব ভালো কথা— নাচব। অফিস ছুটি দিয়ে বাড়িতে চলে এসো, স্ত্রীর নাচ দেখে যাও। চাও দেখতে?
মোতাহার হোসেন টেলিফোন রেখে সুলেমানকে ডেকে পাঠালেন। পৃথিবীর সমস্ত ধনবান ব্যক্তিদের একজন ম্যাজিক পারসন থাকে। যে-কোনো জটিল কাজ এরা করতে পারে। কীভাবে তারা করে সেই বিষয়টি কখনো ব্যাখ্যা করে না।
মোতাহার হোসেনের টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে সুলেমান দাঁড়িয়ে আছে। রোগী লম্বা একজন মানুষ। চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। মাথার চুল এবং গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি সবই পাকা, অথচ বয়স এখনো পঞ্চাশ হয় নি। চেহারা বিশেষত্বহীন। এই চেহারা একবার দেখলে দ্বিতীয়বার আর মনে থাকে না।
কেমন আছ সুলেমান?
স্যার ভালো আছি। আপনার দোয়া।
মোতাহার হোসেন বললেন, দোয়া তো আমি কারো জন্যে করি না।
সুলেমান বলল, এই যে আপনি জিজ্ঞেস করেছেন— কেমন আছ সুলেমান। এতেই দোয়া হয়েছে।
মোতাহার হোসেন বললেন, তালতলার পীর সাহেবের কাছে একটা খবর পাঠাতে হবে। আজ সন্ধ্যায় শুভ্রর মা উনার কাছে যাবেন। উনার দোয়া নেবেন?
জি আচ্ছা।
সুলেমান চলে যাচ্ছে না, দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে জটিল কোনো কাজ তার জন্যে অপেক্ষা করছে। বড় সাহেব জটিল কোনো কাজের আগে একটা অতি সহজ কাজ দেন। একেকজন মানুষের কর্মপদ্ধতি একেক রকম। বড় সাহেব চট করে জটিল কাজে যান না। সুলেমান বলল, স্যার, আর কোনো কাজ আছে?
মোতাহার হোসেন বললেন, আমি বঙ্গোপসাগরে ছোট্ট একটা দ্বীপ কিনতে চাই। এটা কি সম্ভব?
সুলেমান বলল, কেনা সম্ভব না। সরকারি খাস জমি বিক্রি হয় না। তবে নিরানব্বই বছরের জন্যে লীজ নিতে পারেন। লীজ নেওয়া কেনার মতোই।
মোতাহার হোসেন বললেন, নিরানব্বই বছরের জন্যে কেন? একশ বছর না কেন?
সুলেমান বলল, খাস জমি একশ বছরের জন্যে লীজ হয় না। ওদের কী একটা হিসাব আছে আমি জানি না। আপনি যদি জানতে চান আমি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে খোঁজ নিয়ে জানাতে পারি।
জানতে চাচ্ছি না।
সুলেমান বলল, স্যার, আমি কি চলে যাব?
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। টেবিলে রাখা ফাইলের দিকে চোখ ফেরালেন। এর অর্থ হলো— তোমার সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে, তুমি চলে যেতে পার।
জাহানারা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন। তার মাথা দপদপ করছে। সকিনা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। জলপট্টি বদলে দেয়া ছাড়াও তাকে আরেকটি কাজ করতে হচ্ছে— প্রতি দশ মিনিট পর পর মোবাইল টেলিফোনে শুভ্রর ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। চেষ্টায় কোনো ফল হচ্ছে না। টেলিফোন বন্ধ।
জাহানারার মাথার দপদপানি মাইগ্রেনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। এখন চোখ জুলুনি শুরু হয়েছে। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরুর এটা হলো পূর্বলক্ষণ। যদি সত্যি সত্যি ব্যথা উঠে যায় তাহলে তালতলার হুজুরের কাছে যাওয়া যাবে না। খবর দিয়ে না যাওয়া বিরাট বেয়াদবি হবে। জাহানারা অস্থির বোধ করছেন।
সকিনা বলল, মা, আপনি কি মাথার যন্ত্রণার অন্য একটা চিকিৎসা করবেন?
জাহানারা বললেন, অন্য কী চিকিৎসা?
সকিনা বলল, আমাদের গ্রামে অচিনবৃক্ষ বলে একটা বৃক্ষ আছে। বর্ষাকালে সেই বৃক্ষে ফুল ফুটে। তখন যদি কেউ সেই গাছে হাত রেখে কিছু চায় তাহলে সে সেটা পায়।