বিস্মিত মনজু বলল, জ্বি ভাইজান খাব।
শুভ্র বলল, তুমি চেয়ারটায় বসো। তাকিয়ে দেখ আমি কীভাবে কফি বানাই।
মনজু বলল, ভাইজান এর মধ্যেও কি কোনো ম্যাজিক আছে?
শুভ্র বলল, পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যেই ম্যাজিক আছে। এই যে তুমি চেয়ারটায় বসেছ এর মধ্যেও আছে। ম্যাজিক অব গ্রাভিটেশন। মধ্যাকর্ষণের ম্যাজিক। মধ্যাকর্ষণ কে বের করেছিলেন জানো?
জি-না।
স্যার আইজ্যাক নিউটন। পদার্থবিদ্যার সুপার জায়েন্ট। কী পরিমাণ মেধা যে এই মানুষটা নিয়ে এসেছিল…
শুভ্ৰ কথা বলতে বলতে এক্সপ্রেসো মেশিনে কফি বানাচ্ছে। তার দুটি চোখ বন্ধ। মনজু অবাক হয়ে ভাবছে- এইটাই কি ম্যাজিক? চোখ বন্ধ করে কফি বানানো? চোখ বন্ধ করে কফি বানাতে এই মানুষটার কোনোরকম অসুবিধা হচ্ছে না। দু। মগ ভর্তি কফি নিয়ে চোখ বন্ধ করেই সে ফিরে আসছে। মনজুর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে শুভ্ৰ চোখ খুলল।
হালকা গলায় বলল, কফি বানানোর ম্যাজিক কেমন দেখলে? অন্ধ হয়ে যাবার পর আমার যেন কোনো অসুবিধা না হয়- তার ব্যবস্থা।
মনজু অবাক হয়ে বলল, অন্ধ হবেন কেন ভাইজান?
শুভ্ৰ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমার অপটিক নাৰ্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। যে-কোনো একদিন দরবারের সব আলো নিভে যাবে।
মনজু অবাক হয়ে বলল, ভাইজান, এইসব কী বলেন?
শুভ্র সহজ ভঙ্গিতে বলল, এখন যে আমি দেখতে পারছি, this is important. চল যাই। আজ সারাদিন ঘুরব।
মনজু বলল, কোথায় যাবেন ভাইজান?
শুভ্র বলল, আমি ঠিক করেছি এখন প্রতিদিন তোমাকে নিয়ে বের হব। সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখব। মেমোরি সেলে জমা করে রাখব। অন্ধ হয়ে যাবার পর যেন স্মৃতি থেকে দেখতে পারি। স্মৃতির জাবর। তুমিই বলে কোথায় যাওয়া যায়?
ভাইজান, বুড়িগঙ্গায় যাবেন?
যাওয়া যায়। বুড়িগঙ্গার মাঝখানে নৌকা ড়ুবিয়ে ঘসেটি বেগমকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঠিক কোনখানে নৌকাড়ুবি হয়েছিল সেই জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারলে ভালো হতো।
ঘসেটি বেগম কে?
নবাব সিরাজদ্দৌলার খালা। সিরাজদ্দৌলাকে চেন তো?
জি চিনি। উনার ছবিও দেখেছি। আনোয়ার হোসেন সাহেব অভিনয় করেছিলেন। ভাইজান, ছবিটা আপনি দেখেছিলেন? খুবই মারাত্মক।
না, আমি ছবিটা দেখি নি। অনেক কিছু তুমি জানো যা আমি জানি না, আবার অনেক কিছু আমি জানি যা তুমি জানো না। তাহলে কী ঠিক করা হলো? আমরা বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছি।
আপনে যেখানে বলবেন সেখানে যাব।
বুড়িগঙ্গাই ভালো। মনজু, নদীটার নাম বুড়িগঙ্গা কেন হলো? যুবতীগঙ্গা কেন হলো না?
জানি না ভাইজান। আমার বুদ্ধি খুবই কম।
কে বলেছে তোমার বুদ্ধি কম?
আমার দূরসম্পর্কের একজন বোন আছে, রুনু নাম। এইবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিবে। সে বলেছে।
তার কি খুব বুদ্ধি?
জি।
কীভাবে বুঝলে তার খুব বুদ্ধি?
মনজু আগ্রহ নিয়ে বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে সে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে। আমি যতবার তার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি, ততবারই ধরে ফেলেছে।
মেয়েটার নাম রুনু, তাই না?
জি ভাইজান।
মেয়েটাকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো। বুদ্ধি পরীক্ষা করার কিছু টেস্ট আছে। আমি পরীক্ষা করে বলে দেব তার আইকিউ কত।
জি ভাইজান, আমি নিয়ে আসব।
গাড়িতে উঠেই শুভ্র বলল, ড্রাইভার সাহেব, আপনার সঙ্গে যে মোবাইল টেলিফোন আছে সেটা বন্ধ করে দিন। মা একটু পর পর খোঁজ করবে। আমি কোথায় আছি কী করছি- আমি সেটা চাচ্ছি না।
ড্রাইভার বলল, মোবাইল অফ করলে ম্যাডাম খুব রাগ করবেন। শু
ভ্র বলল, রাগ সামলানোর ব্যবস্থা করা যাবে। মোবাইল বন্ধ থাকুক।
ড্রাইভার অপ্ৰসন্ন মুখে মোবাইল অফ করল। শুভ্র ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ড্রাইভার সাহেব, মুখ ভোঁতা করে রাখবেন না। মুখ ভোঁতা করার মতো কিছু হয় নি।
ড্রাইভার শুকনা গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।
শুভ্র মনজুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বোনকে আমাদের সঙ্গে উঠিয়ে নিলে কেমন হয়? সুন্দর সুন্দর দৃশ্য একা বা দোকা দেখা যায় না। তিনজন লাগে। Three is company.
মনজু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাইজান এইসব কী বলছে?
শুভ্র বলল, রুনু কি আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হবে? তোমার কথায় রাজি না হলে আমি অনুরোধ করে দেখতে পারি। রুনু থাকে কোথায়?
মনজু বিড়বিড় করে বলল, যাত্রাবাড়িতে।
শুভ্র ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, আগে যাত্রাবাড়িতে চলুন। সেখান থেকে আমরা যাব বুড়িগঙ্গায়।
মোতাহার হোসেনের নির্দেশ আছে- অতি জরুরি কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হলে বাড়ি থেকে কখনো তাকে টেলিফোন করা যাবে না। অফিস এবং বাড়ি হলো তেল ও জল। যখন তিনি তেলে থাকবেন তখন তেলেই থাকতে চান। ঝাকুনি দিয়ে তেল-জল মেশানোর পক্ষে তিনি কখনো না।
জাহানারা যখন টেলিফোনে আতঙ্কিত গলায় জানালেন, শুভ্ৰ সকাল দশটা এগারো মিনিটে মজনু না-কি ফজনু নামের ছেলেটাকে নিয়ে বের হয়েছে তখন মোতাহার হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন, এটা কি অতি জরুরি কোনো খবর?
জাহানারা বললেন, অবশ্যই জরুরি। এরপর থেকে ওরা কোথায় আমি ট্রেস করতে পারছি না। ড্রাইভার হারামজাদা মোবাইল অফ করে রেখেছে। ওকে আমি বলে রেখেছি শুভ্রকে নিয়ে যখনই বের হবে মোবাইল খোলা রাখবে।
মোতাহার হোসেন বললেন, আমার ধারণা শুভ্ৰই বন্ধ রাখতে বলেছে।
শুভ্ৰ কেন বন্ধ রাখতে বলবে?
তোমার অশরীরী উপস্থিতি হয়তো তার পছন্দ না। তুমি টেনশান করো না।