মনজু বলল, সবসময় কি আর প্ল্যান মতো কাজ হয়?
রুনু বলল, অন্যদের হয় না। আমার হয়।
বলতে বলতে রুনু সোফায় বসল। মনজুর হাতে পান দিতে দিতে মাথা ঘুরিয়ে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে হাসল।
মনজু বলল, হাসছ কেন?
রুনু বলল, বাবা মা আমাকে হঠাৎ বিয়ে দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাত্রও খুঁজতে হয় নি। পাত্র নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। এই জন্যে হাসছি।
মনজু বিস্মিত গলায় বলল, পাত্র কে?
রুনু শব্দ করে হেসে ফেলে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, পাত্র আমার পাশে বসে পান খাচ্ছে।
মনজু অবাক হয়ে বলল, বলো কী?
রুনু বলল, এত খুশি হবেন না। সব নির্ভর করছে আমার উপর। পাত্র আমার পছন্দ হতে হবে।
মনজু অবাক হয়ে ভাবছে মেয়েটা কী সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংকোচ নেই। মনজু বলল, পাত্র তোমার পছন্দ না?
রুনু বলল, না।
মনজু বলল, আমি অবশ্যি পছন্দ করার মতো কেউ না। চেহারা ভালো না। সর্ট। গায়ের রঙও ময়লা।
রুনু বলল, আপনার চেহারা ঠিকই আছে। আপনার যেটার অভাব তার নাম বুদ্ধি।
তোমার ধারণা আমার বুদ্ধি কম?
হ্যাঁ। আমি সারাজীবন কল্পনা করেছি। আমি যাকে বিয়ে করব তার খুব বুদ্ধি থাকবে। চেহারা হবে রাজপুত্রের মতো।
মনজু বলল, কল্পনার মানুষ কল্পনাতেই থাকে, বাস্তবে তাদের পাওয়া যায় না।
রুনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, তা ঠিক। তাছাড়া আমার ভাগ্য এরকম যখন যেটা চেয়েছি তার উল্টোটা হয়েছে। আমি জানি আমার বিয়ে আপনার মতো একজন কারোর সঙ্গে হবে। কে জানে হয়তো আপনার সঙ্গেই হবে।
রুনু খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। মনজুর শরীর ঝিমঝিম করছে। মাথা সামান্য দুলছে। তার মনে হচ্ছে- সে যা দেখছে সেটা স্বপ্ন। সে আসলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন সে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের ফাজলামি। স্বপ্ন তাকে নিয়ে ফাজলামি করছে।
বিশ দিন পর শুভ্রর ঘরে
বিশ দিন পর শুভ্রর ঘরে মনজুর ডাক পড়ল। সকাল আটটা মাত্ৰ বাজে। মনজু নাশতা শেষ করে চা খেতে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে বসেছে। কড়া করে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিনের প্রথম সিগারেট ধরিয়েছে। এমন সময় রহমতউল্লাহ ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ছোট সাহেব ডাকেন।
মনজু হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠিক আছে।
রহমতউল্লাহ বললেন, ঠিক আছে মানে? তাড়াতাড়ি যাও।
মনজু বলল, চা-টা খেয়ে যাই।
রহমতউল্লাহ বিস্মিত গলায় বললেন, তোমার ডাক পড়েছে, তুমি এক্ষণ ছুটে যাবে। আয়েশ করে চা খাওয়া আবার কী?
মনজুরহমতউল্লাহরতউল্লাহর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে মোটামুটি আয়েশ করেই চায়ে চুমুক দিল।
রহমতউল্লাহ বললেন, ব্যাপারটা কী তোমার? তুমি কি এইখানে চাকরি করতে চাও না? মাঝখানে এক রাত কোথায় কাটায়ে এসেছ। তোমার ভাগ্য ভালো, আমি রিপোর্ট করি নাই। এখন আবার নবাবী চালে চা খাচ্ছ।
মনজু বলল, আমি ঠিক করেছি। ছাতার চাকরি করব না।
চাকরি করবে না?
না। চাকরের চাকরি আমার পোষাবে না।
ছোটসাহেবের সঙ্গে দেখা করবে না?
দেখা করলেও করতে পারি। চাচাজি, আপনি চা খাবেন? এরা চা ভালো বানায়। খান এক কাপ। পয়সা আমি দেব।
রহমতউল্লাহ রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলেন। মনজু প্ৰথম কাপ চা শেষ করে দ্বিতীয় কাপ নিল। আরেকটা সিগারেট ধরাল। দিনের প্রথম চায়ের সঙ্গে পর পর দুটা সিগারেট খেতে হয়। মামা-ভাগ্নে সিগারেট।
রহমতউল্লাহ বললেন, মনজু, তুমি চাকরি কর বা না কর ছোটসাহেব ডেকেছেন দেখা করে আস।
মনজু বলল, যাচ্ছি। সিগারেট শেষ করেই যাচ্ছি। আপনি এত অস্থির হবেন না। অস্থির হবার কিছু নাই।
রহমতউল্লাহ বললেন, তোমার সমস্যাটা কী?
মনজু বলল, আমার কোনোই সমস্যা নাই। সমস্যা আপনার। খাবেন এক কাপ চা? দিতে বলব?
শুভ্র কালো রঙের প্যান্টের সঙ্গে ধবধবে সাদা সার্ট পরেছে। তাকে দেখাচ্ছে শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো। শ্বেতপাথরের মূর্তির চুল বাতাসে উড়ে না। সে ফ্যানের নিচে বসে আছে বলে তার মাথার চুল উড়ছে। শুভ্র মনজুকে দেখেই হাসি মুখে বলল, Hello young man and the tree.
মনজু কিছু বলল না। সে অদ্ভুত রূপবান যুবকের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। হুট করে তার মাথায় অদ্ভুত একটা চিন্তা চলে এলো। ইস, সে যদি রুনুকে শুভ্ৰ ভাইজানের সামনে দাঁড়া করাতে পারত! রুনু কী বলত তাকে দেখে?
শুভ্র বলল, বুড়োমানুষ দেখলেই আমার মাথায় সমুদ্রের ইমেজ চলে আসে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে Old man and the sea উপন্যাসটি লিখে এই কাণ্ডটা করেছেন। তার উপন্যাসটা পড়ার পর পরই আমার ইচ্ছা করল। আমি একটা উপন্যাস লিখি যার নাম Young man and the tree, শেষপর্যন্ত অবশ্যি লেখা হয় নি। তুমি হেমিংওয়ের বই পড়েছ?
জি-না।
উনার নাম শুনেছে?
জি-না। ভাইজান, আমি ইংরেজি তেমন জানি না।
তাতে অসুবিধা নেই, হেমিংওয়ের বইয়ের বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়।
ভাইজান, আমার বই পড়তে ভালো লাগে না।
ভালো বই কখনো পড় নি বলে ভালো লাগে না। ভালো বই পড়ে দেখতে হবে। মানুষ খুবই উন্নত প্রাণী। ভালো জিনিস যাতে তার ভালো লাগে প্রকৃতি সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে।
সব মানুষ একরকম না। কেউ আপনার মতো, আবার কেউ আমার মতো।
শুভ্র বলল, আচ্ছা থাক, পরে এই নিয়ে কথা বলব। তুমি কেমন আছ?
ভাইজান, আমি ভালো আছি।
কফি খাবে? এক্সপ্রেসো কফি— প্রচুর ফেনা। অতিরিক্ত মিষ্টি।