আর কী খাবে? ভাপে ইলিশ করব?
করেন।
তোমার মামা এনেছে পাবদা মাছ। আজ তিন রকম মাছ থাকুক।
রুনু বলল, ভাপে ইলিশ আমি রান্না করব মা।
শায়লা বললেন, তোর রান্না করতে হবে না। তুই মনজুর সঙ্গে গল্প কর।
রুনু বলল, দুই দিন পরে আমার পরীক্ষা, এখন আমি উনার সঙ্গে গল্প করব? তোমার ছেলে তুমি গল্প কর। আমার এত গল্প করার শখ নাই।
শায়লা রান্না বসিয়েছেন। ইকবাল সাহেব মোড়া পেতে রান্নাঘরে বসে আছেন। আয়োজনের রান্না-বান্না দেখতে তার ভালো লাগে। তার হাতে চায়ের কাপ। খুবই আরাম করে তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। শায়লা বললেন, আমি একটা বিষয়ে মনস্থির করেছি। তুমি কোনো আপত্তি করতে পারবে না।
ইকবাল সাহেব বললেন, কোন বিষয়ে?
শায়লা বললেন, কোন বিষয় তা তুমি অনুমান করতে পারছি। পারছি না?
হুঁ।
তোমার কিছু বলার আছে? ইকবাল সাহেব বললেন, ছেলে খুবই ভালো কিন্তু মেয়ের মতামতের একটা বিষয় আছে।
শায়লা বললেন, তার আবার কিসের মতামত?
ইকবাল সাহেব বললেন, আমার অবশ্য ধারণা মেয়ে ছেলেটাকে খুব পছন্দ করে। যে চিৎকার দিয়েছিল এখনো কানে তালা লেগে আছে। তবে সমস্যা একটা আছে।
কী সমস্যা?
ইকবাল সাহেব বললেন, ছেলের মা নাই বাবা নাই— অনাথ ছেলে। শায়লা বললেন, ছেলের মা-বাবা থাকবে না। কী জন্যে? আমি মা-না? তুমি এই বিষয়ে কোনো উল্টা কথা বলব না। অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে চাও বলো। এই বিষয়ে না।
ইকবাল সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টালেন। খুশি খুশি গলায় বললেন, এক কাজ করি, খাসির মাংসটা আমি রান্না করে ফেলি। টাটকা টাটকা খাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে।
শায়লা বললেন, তুমি রাঁধতে চাইলে রাধ। কাটা মসলার মাংস করা। এটা তোমার ভালো হয়। মাংস রাঁধতে হলে কিন্তু আদা-পেঁয়াজ আনতে হবে। ঘরে আদা-পেঁয়াজ নেই।
রান্নাবান্নায় এই ভদ্রলোকের খুবই শখ। মাঝে-মধ্যেই এটা-সেটা রান্না করেন। তিনি খুবই আগ্রহ নিয়ে আদা-পেঁয়াজ আনতে রওনা হলেন।
রুনু অতি মনযোগে বান্ধবীর নোটবুক কপি করছে। তার সামনেই মনজু বসে আছে। মনজুর সঙ্গে তার কোনো কথা হচ্ছে না। মনজুর দিকে না তাকিয়েও সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, মনজু তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোনো পুরুষমানুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকলে তার একেবারেই ভালো লাগে না। গা ঘিনঘিন করে। এখন করছে না। বরং ভালো লাগছে। লাজ্জাও লাগছে। এই লজ্জার মধ্যেও আনন্দ মিশে আছে।
রুনু বলল, আপনি চুপচাপ বসে আছেন কেন?
মনজু বলল, তুমি কাজ করছ, চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আমার গতি কী!
আপনার অফিস কেমন চলছে?
ভালো, তবে খুবই কাজের চাপ। এতদিন আসতে পার নি কাজের চাপে। আমার যে ইমিডিয়েট বাস উনি হঠাৎ ছুটিতে গেলেন। স্ত্রীর ক্যানসার হয়েছে, স্ত্রীকে নিয়ে তাকে যেতে হলো সিঙ্গাপুর। তার সমস্ত কাজ এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। আমি নতুন মানুষ, আমি কি এতসব জানি? পনেরো দিনে একবার গেলাম চিটাগাং। আর ছবার গেলাম খুলনায়। বিমানে যাতায়াত করেছি, তারপরেও ধকল কম না।
রুনু বলল, মনজু ভাই, আপনার কথা বলার মধ্যে মনে হয় কোনো সমস্যা আছে। আপনি যখন কথা বলেন তখন মনে হয় মিথ্যা বলছেন।
কী বলো?
আসলেই তাই। আপনার প্রতিটি কথা মিথ্যার মতো শোনাচ্ছে। যদিও আমি জানি আপনি মিথ্যা বলছেন না। আগেও এরকম মনে হয়েছিল। চাকরি নিয়ে কথা বলেছিলেন, আমার কাছে মনে হয়েছিল মিথ্যা। পরে দেখা গেল সত্যি।
মনজু চিন্তিত গলায় বলল, এরকম কেন হয় বলো তো?
রুনু বলল, জানি না কেন হয়। মনে হচ্ছে আপনার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। আপনি একটা কাজ করুন— ভয়ঙ্কর কোনো মিথ্যা বলুন, দেখি মিথ্যাটা সত্যির মতো মনে হয় কি-না।
মিথ্যা বলব?
হুঁ।
বেশ তাহলে শোন, আগে বলেছিলাম না। আমার মা মারা গেছেন? আসলে মা বেঁচে আছেন। ভালো মতো বেঁচে আছেন। ইসমাইল সর্দার নামে অতি বদলোককে বিয়ে করেছেন। এই স্বামীর প্রতিভায় আমার মা মুগ্ধ।
রুনু বলল, আপনার মিথ্যাগুলি আমার কাছে সত্যি মনে হচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার তো!
মনজু চিন্তিত গলায় বলল, আশ্চর্য তো বটেই।
রাতে মনজু চলে যাবে। এগারোটায় গোট বন্ধ হয়। তার আগেই যেতে হবে। শােয়লা বললেন, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে আমি ছাড়ব না। মনজু বলল, রাত এগারোটার মধ্যে উপস্থিত না হলে আমার চাকরি চলে যাবে মা।
রুনু বলল, চাকরি চলে গেলে চলে যাবে, আপনি যেতে পারবেন না।
মনজু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, থাকব।
শায়লা স্বামীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন। তাকে তখন মনে হচ্ছিল তিনি এই পৃথিবীর সুখী মাদের একজন।
ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মনজুকে বিছানা করে দেয়া হয়েছে বসার ঘরের সোফায়। সে বেশ আয়েশ করে শুয়েছে। পায়ের কাছের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে ঠাণ্ড বাতাস আসছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাট আসছে। মনজুর ভালো লাগছে। ঘুম ঘুম লাগছে, আবার ঘুম আসছে না- এমন অবস্থা।
মনজু ভাই, পান খাবেন?
রুনু হাতে পানের খিলি নিয়ে ঢুকেছে। তার মুখেও পান। পানের লাল রঙ ঠোট বেয়ে নেমে এসেছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। মনজুর মনে হলো এই মেয়েটা যদি তার স্ত্রী হতো তাহলে সে অবশ্যই হাত দিয়ে ঠোঁটের লাল রঙ মুছিয়ে দিত।
মনজু বলল, রুনু বস।
রুনু বলল, বসব কেন? আপনি কি ভেবেছেন আমি পান হাতে নিয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। আমি এক্ষুণি পড়তে বসবা। আজ রাত তিনটা পর্যন্ত আমার পড়ার প্ল্যান।