চিন্তায় মিলে বস্তু, না চিন্তায় নাই। জাগরণে দেখি না যারে, নিদ্রায় পাই।
তোমারে পছন্দ হয়েছে বলেই ভিতরের দুএকটা কথা বললাম। আরো যদি পছন্দ হয় আরো বলব। বুঝেছি? এখন আর কথা বলতে পারতেছি না। বমি চাপাচ্ছে। আমাকে বাথরুমে নিয়ে যাও। বমি করব। পিছন দিক দিয়া ধর। সামনে থাকবা না। সামনে থাকলে তোমার শরীরে বমি করতে পারি। বমির পরে আমার হাত-মুখ ধোয়াইয়া বিছানায় শোয়ায়ে দিবা। এবং দুই পায়ের চিপায় দিবা কোলবালিশ।
আমি তোমারে পুত্রের মতো দেখি, তুমি আমারে দেখবা পিতার মতো। এটাই হলো হিসাবের কথা। জগৎ চলে হিসাবে। যিনি জগৎ চালান, আমরা যাকে বলি আল্লাহ, খ্রিষ্টানের পুতরা বলে God, মালাউনরা বলে ঈশ্বর, তিনি অংকে বড়ই পাকা। সবসময় দশে দশ। বুঝেছি? জ্ঞানের কথা বললাম। সব সময় বলি না। তোমাকে স্নেহ করি বলে বলেছি। ওয়াক ওয়াক ওয়াক! শালার বমি। তুই থাকাস কই?
মায়া লজের স্টাফদের বেতন হয় মাস পুরা হবার একদিন আগে। ত্ৰিশ মাস হলে ত্ৰিশ তারিখে, একত্ৰিশ মাস হলে একত্রিশ তারিখে। বেতন দেন রহমতুল্লাহ। রেভিনিউ স্ট্যাম্পে সই করে বেতন নিতে হয়। মনজু তার জীবনের প্রথম বেতন নিল। ছয় হাজার টাকা অ্যাডভান্সের কিছু বেতন থেকে কাটার কথা। দেখা গেল বেতন কাটা হয় নি। রহমতুল্লাহ বললেন, বেতন আসে হেড অফিস থেকে। তারা কাটে নাই। হেড অফিস কোনোদিন ভুল করবে না। তোমাকে যে অ্যাডভান্স দেয়া ওয়েছিল সেটা মাফ হয়ে গেছে। মনজু বলল, মাফ হবে কেন?
রহমতুল্লাহ বললেন, কোম্পানিতে যারা চাকরিতে ঢুকে, তাদের সবাইকে প্রথমে এক মাসের বেতন লোন হিসেবে দেওয়া হয়। মাসে মাসে কাটা হবে। এরকম বলা থাকে। শেষপর্যন্ত কাটা হয় না। এই কোম্পানিতে চাকরির এটা এক সুবিধা।
মনজু আনন্দিত গলায় বলল, বলেন কী? রহমতউল্লাহ বললেন, অত খুশির কিছু নাই। সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও আছে।
মনজু বলল, অসুবিধা কী?
রহমতউল্লাহ বললেন, এত প্যাচাল তোমার সঙ্গে পারতে পারব না। সুবিধাঅসুবিধা নিজেই জানবা।
মনজু বলল, চাচাজি, আমি কি ঘণ্টা দুই তিনের জন্যে ছুটি পাব? এতদিন ধরে এক জায়গায় পড়ে আছি, দম বন্ধ হয়ে আসছে।
রহমতউল্লাহ বললেন, চাকরির অসুবিধার কথা জানতে চেয়েছিলা। এই হলো এক অসুবিধা। দম বন্ধ হয়ে আসে। দম ফেলার জন্যে যেখানে যাবে দেখবে সেখানেও দম বন্ধ। ঘর বাহির সমান। খবর পেয়েছি ছোট সাহেবের শরীর খারাপ, তাকে দেখতে ডাক্তার এসেছে। কাজেই যেখানে ইচ্ছা যাও। রাত এগারোটার আগে ফিরব। এগারোটায় গোট বন্ধ।
রুনু সবসময় লক্ষ করেছে সে যখন খুব মন দিয়ে কিছু করে তখনি কলিংবেল বাজতে থাকে। সেই কলিংবেলের শব্দ বাড়ির আর কেউ শোনে না। শুধু সে একা শুনতে পায়।
রুনু তার বান্ধবীর নোট কপি করছিল। একগাদা নোট সকালে ফেরত দিতে হবে। এই সময। কলিংবেল বাজছে। বাসায় বাবা আছে, মা আছে, একটা কাজের মেয়ে আছে। কলিংবেলের শব্দ কেউ শুনছে না। রুনু ঠিক করল, কলিংবেল বাজতে থাকুক, সে দরজা খুলবে না। বাসায় দরজা খোলার দায়িত্ব শুধু তার একার কেন হবে? বাড়ির অন্য সদস্যরা যদি সময় সময় বধির হতে পারে, তাহলে সেও পারে।
শেষপর্যন্ত রুনুকেই উঠতে হলো। মহাবিরক্ত হয়ে সে দরজা খুলল। দুই হাতে দুই বাজারের ব্যাগ নিয়ে মনজু দাঁড়িয়ে আছে। রুনু বলল, একী!
মনজু বলল, রুনু, ভালো আছ?
রুনু চিৎকার দিয়ে বলল, মা, মনজু ভাই এসেছে।
চিৎকার দিয়ে সে নিজে খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ল। সে ভেবেই পাচ্ছে না। এত জোরে সে চিৎকারটা কেন দিল! মনজু ভাই কি এমন কেউ যে তাকে দেখে কানের পর্দা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে হবে?
শায়লা রান্নাঘরে মাছ কুটছিলেন, তিনি সেখান থেকে ছুটে এলেন। ইকবাল সাহেব ভেতরের বারান্দায় খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তিনি চলে এলেন কাগজ হাতে। সবার ব্যস্ততা এমন যে এই বাড়ির অতি প্রিয় একজন দীর্ঘ নিরুদ্দেশের পর ফিরে এসেছে। শায়লা বললেন, বাবা, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আমাদের একটা খোঁজ দিবে না?
ইকবাল সাহেব বললেন, একটা ফরওয়ার্ডিং অ্যাড্রেস রেখে গেলে আমিই খুঁজে বের করতাম। কিছুই রেখে যাও নাই। তোমার তো দেখি কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নাই।
রুনু বলল, ব্যাগে করে কী এনেছেন বের করেন।
মনজু বলল, সামান্য কাচাবাজার। মাছ-মাংস।
রুনু বলল, লোকজন আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এলে মিষ্টি আনে, দই আনে। আপনি আনেন কাচাবাজার। আপনার এই অদ্ভুত অভ্যাস কেন?
মনজু বলল, মাকে খুশি করার জন্যে কাঁচাবাজার আনি। পৃথিবীর সমস্ত মায়েরা কাচাবাজার দেখলে খুশি হয়।
রুনু বলল, পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের খবর আপনি জেনে গেছেন? আপনি কাচাবাজার আনেন। কারণ আপনি পেটুক মানুষ, খেতে পছন্দ করেন।
মনজু ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করছে। সবাই আগ্রহ করে দেখছে। প্রথমে বের হলো মাঝারি সাইজের একটা কাতল মাছ। ইকবাল সাহেব বললেন, মাছটা ফেস আছে। বিলের কাতল। টেস্ট ভালো।
তারপর বের হলো একটা ইলিশ মাছ। মোটামুটি বড় সাইজের গলদা চিংড়ি। বড় বড় শিং, মাছ। কিছু মলা মাছ। খাসির একটা আস্ত পা।
শায়লা আনন্দিত গলায় বললেন, এত কিছু এনেছ কেন? তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়েছে? রাতে কী খাবে বলো? রাতে কী রান্না করব?
মনজু বলল, ঝাল দিয়ে শিং মাছের ঝোল রান্না করেন। শিং মাছের ঝোল খেতে ইচ্ছা করছে।