এই চিঠিও শেষপর্যন্ত লেখা হয় নি এবং পাঠানো হয় নি। মনজুর আসলে কোনো কিছুতেই মন বসছে না। দিন কাটছে না। প্রতিদিন একই রুটিন— সকালে নাস্তা (নাস্তাও এক রকম, খিচুড়ি ডিম ভাজি), নাস্তার পর ঘরের সামনে সকাল এগারোটা পর্যন্ত বসে থাকা।
এগারোটার পর শুরু হয় ড্রাইভারদের ক্যারাম খেলা। ঘণ্টা দুই ক্যারাম খেলা দেখা। সবচে ভালো খেলে চশমা পরা দারোয়ান। সে আবার সিঙ্গেল খেলে না। বাজি ছাড়াও খেলে না। দশ টাকা বাজি রেখে তার সাথে খেলতে হয়। দুপুরের খাওয়ার পর ঘুম। ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে ঘণ্টা দুএক বসে থাকা। রাত দশটা থেকে শুরু হয় ড্রাইভারদের তাস খেলা। খেলার নাম কাচু। ঘণ্টা দুই খেলা দেখে ঘুমাতে যাওয়া।
বাড়ির কেয়ারটেকার রহমতুল্লাহ সাহেবের ঘরে টেলিভিশন আছে। কোনো কোনো রাতে নাটক থাকলে নাটক দেখা। এক জোড়া নায়ক-নায়িকা প্ৰেম করে। কেন করে তারা জানে না। তাদের মধ্যে মিলন হয়। কেন হয় কে জানে! আবার মাঝে মাঝে বিরহ হয়। কী জন্যে হয় তাও বোঝা যায় না।
রহমতুল্লাহ সাহেবের ঘরে টিভি দেখতে যাওয়াও শাস্তির মতো। তিনি সারাক্ষণ শরীর চুলকান এবং কথা বলেন। তার কথাও টিভির নাটকের মতো। কেন বলেন, কী জন্যে বলেন, তিনি জানেন না। তার কমন ডায়ালগ হচ্ছে— মন দিয়ে কাজ কর। কাজে দিবে মন মিলিবে ধন। বাঙালির কোনো আয়-উন্নতি নাই কারণ তাদের কাজে মন নাই। তাদের মন কোথায়? তাদের মন অজুহাতে। কাজ না করার অজুহাত। বাঙালির তিন হাত। ডানহাত, বামহাত আর অজুহাত। তিনটা হাতের মধ্যে সে ডানহাত-বামহাত কোনোটাই ব্যবহার করে না। ব্যবহার করে শুধু অজুহাতটা।
বুড়ো যখন বকবক করতে থাকে, তখন মনজু এমন ভাব করে যেন সে বুড়োর প্রতিটা কথা গিলে খাচ্ছে। আসলে সে তখন মনে মনে বলে, এই বুড়া, চুপ করবি? চুপ না করলে টান দিয়ে তোর জিব ছিড়ে ফেলব। তুই যখন কথা বলিস, তখন তোর মুখ দিয়ে থুথু বের হয় এটা জানিস? তোর থুথু খাওয়ার জন্যে বসেছি?
রহমতুল্লাহ আবার হঠাৎ হঠাৎ কোথেকে মদ খেয়ে আসে। এই সময় তার।্যবহার হয় অতি মধুর। হাসি ছাড়া মুখে কথা নেই। কথা বলবে গায়ে হাত দিয়ে। মাতালের নেশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে— এই বুড়োর উল্টো নিয়ম। রাত যতই গভীর হয়, তার নেশা ততই বাড়ে। এক পর্যায়ে শুরু হয় কেচ্ছা কাহিনী। সব কেচ্ছা কাহিনীই মায়া লজ কেন্দ্ৰিক।
এই যে মনজুমিয়া, এই বাড়িতে ভূত আছে জানো? ভূত ঠিক না, পেত্নী। অনেকেই দেখেছে। আমি নিজে দেখেছি দুইবার। প্রথমবার দেখি চৈত্র মাসে। হয়েছে কী, সেবার গরম পড়েছে বেজায়। ফ্যানের বাতাসে কোনো কাজ হয় না। উল্টা শরীর জ্বালাপোড়া করে। রােত তখন দুটা-আড়াইটা বাজে। আমি ভাবলাম বাগানে গিয়া বসি। শরীরটা ঠাণ্ডা করে আসি। রওনা হয়েছি বাগানের দিকে, কিছুদূর যাবার পরে দেখি, দোলনায় একটা মেয়েছেলে আপন মনে দোল খাচ্ছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। প্রথমে মনে হলো ছোট সাহেবের মা। উনি এত রাতে দোলনায় বসে আছেন কেন— এটা বুঝলাম না। বাগানে উনার আসার কথা না। উনি কুত্তা ভয় পান। তাহলে কি কাজের মেয়েদের কেউ? কাজের মেয়েদের এত সাহস হবার কথা না। আমি ধান্ধায় পড়ে গেলাম। তখন দেখি, দোলনায় বসা মেয়ে হাত ইশারায় আমাকে ডাকল। আমি আগায়ে গিয়েছি। রাত দুটার সময় দোলনায় বসে থাকে, হাত ইশারায় আমাকে ডাকে, মেয়েটা কে আমার দেখা দরকার। আমার সন্দেহ হলো, ড্রাইভার-দারোয়ান এদের কেউ বাজারের মেয়ে ভিতরে পাচার করেছে কি-না। আগে একবার এইরকম ঘটনা ঘটেছিল, তাতে তিনজনের চাকরি চলে যায়। তবে দোলনায় বসা মেয়েটাকে বাজারের মেয়ের মতো মনে হচ্ছে না। মাথায় ঘোমটা দিয়ে শাড়ি পরেছে। নিজেকে ঢেকে-ঢুকে খুবই ভদ্রভাবে বসেছে। চুল খোঁপা করা। বাজারের মেয়েরা চুল খোঁপা করে না। ছেড়ে রাখে।
আমি আরো কয়েক কদম আগায়েছি। হাসির শব্দ শুনলাম। মানুষের হাসি না। জন্তু-জানোয়ারের হাসি। ভকভক শব্দ। মেয়েটা হাসছে নাকি? এটা কী রকম হাসি? আমি বললাম, তুমি কে? বলে তাকিয়েছি, দেখি মেয়েটা ঠিকই দোলনায় বসে আছে, তবে তার গায়ে একটা সুতা নাই। ঘটনা এইখানে শেষ না। মেয়েটা তখন কথা বলা শুরু করল। মিষ্টি গলার স্বর। আমাকে বলল, গরম বেশি বলে কাপড়-চোপড় খুলে ফেললাম। তুই মনে কিছু নিস না। তুই আমার ছেলের মতো। ছেলের সামনে মায়ের আবার লজ্জা কী? আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। আমার জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে।… আমার কথা তোমার বিশ্বাস হয় না? যদি আমি একটা শব্দ মিথ্যা বলি, তাহলে আমি সতী মায়ের গর্ভের সন্তান না। আমি জারজ, আমার পিতা জারজ। এখন বিশ্বাস হয়?
নতুন চাকরি করতে এসেছি। মনে অনেক রঙ ঢঙে। শোন মজনু মিয়া, এই বাড়ি কোনো সহজ বাড়ি না। এই বাড়ি জটিল বাড়ি। এই বাড়ির হিসােব জটিল হিসাব। তুমি ভাবতেছ। আমি এক মাতাল লোক। মাতালের কথার হিসাব নাই। ভুল ভাবতেছ। বেহিসেবি কথা কয় সুস্থ মানুষ। মাতাল বলে হিসাবের কথা। সমস্যা একটাই, তোমাদের মুখে ছাকনি আছে। মাতালের মুখে ছাকনি নাই।
এই বাড়ির আরেকটা হিসাব একটু বিবেচনা কর— ছোট সাহেবরে তো দেখেছ, তোমার শুভ্ৰ ভাইজান। তার মতো সুন্দর চেহারার যুবক দেখেছ? দেখ নাই। দেখার উপায় নাই। তার মতো সুন্দর আরেকটা পুরুষ জন্মেছিল। তার নাম জানো? হাদিস-কোরান পড়বা না, নাম জানিবা কীভাবে? তিনিও একজন নবী। তার নাম ইউসুফ। যার প্রেমে পাগল হয়েছিলেন জুলেখা বিবি। এখন কথা হলো, আমাদের ছোট সাহেবের চেহারা রূপকথার রাজপুত্রের চেয়েও সুন্দর। তার পিতার চেহারা ছবি কী? পোড়া কাঠ। লঙ্কার হনুমান। আর মার চেহারা কী? বিড়ালমুখি। দেখলে মনে হয় সাদা হুতা বিড়াল। Cat women। এত সুন্দর একটা ছেলে যে তাদের হয়েছে হিসাবটা কী? মাঝে-মধ্যে চিন্তা করব। চিন্তার খোরা দিয়া দিলাম। Food for thought.