এখন ঘরের সংবাদ শোন। সংসারের অবস্থা বেহাল। বলা চলে প্রায় উপবাসের সম্মুখীন হইয়াছি। বর্গাদাররা ধানচাল কিছুই ঠিকমতো দিতেছে না। বাড়ির যে এক অংশ জনৈক এনজিও কমীকে ভাড়া দিয়াছি, সেও নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করিতেছে না। প্রতিমাসেই নানান টালবাহানা করে। অন্যজু তার দুই পুত্র নিয়া উপস্থিত হওয়াতে আরো ঝামেলায় পড়িয়াছি। অনঙ্গুর স্বামী ইতালি হইতে তাহার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়া কাগজপত্র পাঠাইয়াছে। সব কাগজপত্ৰ আমি লুকাইয়া রাখিয়াছি। অন্যজু এখনো আশায় আশায় আছে যে ডিভোর্স হয় নাই। যদি জানে ডিভোর্সের কাগজ চলিয়া আসিয়াছে, তাহা হইলে সে কী করিবে তার নাই ঠিক। গলায় ফাস দেয়া বা বিষ খাওয়া বিচিত্র কিছু না।
তোমার সৎবাবা অনজুর পুত্র দুইটির খোরপোষ আদায়ের জন্যে মামলা করিতে চান। এই বিষয়ে তিনি অনজুর শ্বশুরের সঙ্গেও পরামর্শ করিতে চান। তুমি তো জানো, এইসব বিষয়ে তোমার সৎবাবার চিকন বুদ্ধি। তিনি অবশ্যই খোরপোষের ব্যবস্থা করিতে পরিবেন, তবে তার জন্যও টাকার প্রয়োজন। তুমি অতি শীঘ্রই ব্যবস্থা কর।
উনার শরীরও ভালো যাইতেছে না। এই বয়সে বিছানায় পড়িয়া গেলে আর উঠিতে পারিবে না। আমি কবিরাজের পরামর্শে তার জন্যে ছাগ-দুগ্ধের ব্যবস্থা করিয়াছি। হাত একেবারেই খালি। সমস্ত ব্যবস্থাই ধার-দেনা করিয়া করিতে হইতেছে। তুমি অতি শীঘ্রই ব্যবস্থা কর।
এদিকে অনজুর দুই ছেলে বড় উৎপাত করিতেছে। আমি আমার জীবনে এরকম গুণ্ডাপ্রকৃতির শিশু দেখি নাই। ঘটনা কী হইয়াছে শোন। তোমার সৎবাবার শরীরটা ভালো যাইতেছে না। আগেই বলিয়াছি। গত সোমবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি ঘুমাইতেছিলেন। তখনই এই দুই গুণ্ডা ঘুমের মধ্যেই তাহাকে কামড়াইয়া ধরে। একজন ঘাড়ে কামড় দেয়। অন্যজন ডান পায়ের হাঁটুতে। রক্তারক্তি কাণ্ড। আমি এবং অন্যজু আমরা দুইজনে মিলিয়া এই দুই বজ্জাতকে ছুটাইতে পারি না এমন অবস্থা। উনাকে এটিএস ইনজেকশন দেওয়া হইয়াছে। আমি দুই বজ্জাতকে কিঞ্চিৎ শাসন করিয়াছি বলিয়া অনজু আমার সহিত বাক্যালাপ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। আমার হইয়াছে উভয়সংকট।
যাই হোক বাবা, সংসারের এইসব টুকিটাকি নিয়া তুমি উদ্বিগ্ন থাকিও না। মন লােগাইয়া কাজ করা যেন মালিক সন্তুষ্ট থাকেন।
নিশ্চয়ই এক তারিখে তোমার বেতন হইবে। বেতন হওয়া মাত্র তোমার পক্ষে যতটা পাঠানো সম্ভব ততটা পাঠাইবে। সংসারের অবস্থা ভয়াবহ। সব কথা খুলিয়া বলা যাইতেছে না। এই বিষয়ে আরেকটি জরুরি কথা বলি। পোস্ট অফিসে ইদানীং টাকা মারা যাইতেছে। মনিঅৰ্ডার ঠিকমতো পৌঁছিতেছে না। তোমার সৎবাবা একটি ভালো বুদ্ধি দিয়াছেন। উনি বলিয়াছেন প্রতি মাসের এক তারিখে ঢাকা গিয়া তোমার নিকট হইতে টাকা নিয়া আসিবেন। তাহার আসা-যাওয়াতে কিছু বাড়তি খরচ হইলেও টাকা মার যাইবে না। এসব বিষয়ে উনার বুদ্ধি অতি পরিষ্কার। তুমি কী বলো? উনার নিজের জন্যেও ঘোরাঘুরির কিছু প্রয়োজন আছে। একটা মানুষ তো আর দিনরাত ঘরে বসিয়া থাকিতে পারে না। বেচারার এমিতেও ভ্রমণের শখ। বয়সকালে দার্জিলিং বোম্বাই এইসব জায়গায় বেড়াইয়াছে। এখন টাকাপয়সার অভাবে গৃহবন্দি।
কাগজ শেষ হইয়া গিয়াছে বলিয়া আর কিছু লিখিতে পারিতেছি না। সংসারের এমন হাল যে চিঠি লেখার কাগজ পর্যন্ত নাই। সবই আল্লাহপাকের পরীক্ষা। উনি দুঃসময় দেন, আবার উনিই সুসময় দেন। বাবাগো, আল্লাহপাককে সর্বদা স্মরণ রাখিও। শুক্রবারের জুম্মার নামাজ যেন কখনো মিস না হয়। তোমার সৎবাবাকেও দেখি অন্য নামাজ পড়তে পারেন বা না পারেন। জুম্মার নামাজ মিস হয় না।
ইতি
তোমার মা রহিমা বেগম
মার চিঠি মনজু কখনো দ্বিতীয়বার পড়ে না। দ্বিতীয়বার পড়ার মতো কোনো বস্তু চিঠিতে থাকে না। তার সব চিঠি একরকম— অভাবের ঘ্যানঘ্যাননি, প্যানপ্যাননি। মাঝে মাঝে তরকারিতে লবণের মতো ইসমাইল সর্দারের চিকন বুদ্ধির প্রশংসা। মনজু অবশ্যি মায়ের এবারকার চিঠি পাঁচবার পড়ল। ইসমাইল সর্দার কামড় খেয়ে কুপোকাৎ— এই অংশটা পড়ার জন্যেই পাঁচবার পড়া। বাচ্চা দুটার জন্যে অবশ্যই ভালো কোনো উপহার কিনে পাঠাতে হবে। দাঁতের জন্যে আলাদা ভিটামিন। এদের নামও বদলে দিতে হবে। একজনের নাম হবে টুং, আরেকজনের নাম টাং।
মায়ের চিঠির জবাব এখনো লেখা হয় নি। একেক সময় একেক জবাব মাথায় আসছে। যত সময় যাচ্ছে চিঠির জবাবের ভাষা পাল্টে যাচ্ছে। ভাষা নরম হয়ে আসছে। চিঠি পড়ার পর পর যে জবাবটা মাথায় এসেছিল সেটা এক লাইনের জবাব এবং ইংরেজিতে—
Everybody go to hell.
পরদিন মাথায় জবাবটা এলো বাংলায়। ভাষা এত কঠিন না। তবে নরমও না। মাঝামাঝি।
মা শোন, তোমার ইসমাইল সর্দারের প্যানপ্যাননি বন্ধ করবে? অবশ্যই তুমি তাকে আমার কাছে পাঠাবে না। চিকন বুদ্ধির লোক আমার পছন্দ না। তার চিকন বুদ্ধি তোমার জন্য তোলা থাকুক। আমার দুই ভাগ্নেকে আদর ও দোয়া দিবে। তারা উত্তমকর্ম করেছে। এবং শরীর ভালো কয়ারর জন্যে তাদেরকে এই পরামর্শ দিবে। এবং শরীর ভালো করার জন্যে তাদেরকেও ছাগ-দুগ্ধ খাওয়াবে। আরেকটা কথা, আমি কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারব না। আমার চাকরির কোনো ঠিক নেই। যে-কোনো মুহুর্তে চাকরি চলে যাবে। আর যদি নাও যায়, আমি নিজেই ছেড়ে দেব।
চাকরি ছেড়ে দিব কারণ এই চাকরি আমি করতে পারছি না। আমার কাজ কী জানো? আমার কাজ- চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকা। যদি ডিউটিতে ডাক পড়ে তাহলে ডিউটিতে যাব। ডিউটির ডাকের জন্যে অপেক্ষা— কী যে কষ্টের ব্যাপার তুমি বুঝবে না। যাদের যাবজীবন হয়েছে, আমার মনে হয় তারাও আমার চেয়ে সুখী…।