সকিনা বলল, কুষ্টিয়ার মেহেরপুর। গ্রামের নাম নিমতলি, পোস্টাফিস নিমতলি।
শুভ্র বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের গ্রামের অচিনবৃক্ষ দেখতে যাব।
বর্ষার মধ্যে যেতে হবে ভাইজান। আষাঢ়-শ্রাবণ— এই দুই মাস ফুল থাকে।
শুভ্র বলল, আমি এই বর্ষার মধ্যেই যাব। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।
সকিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হয় আরো কিছু বলার আছে। শুভ্র বলল, আর কিছু বলবে?
সকিনা না-সূচক মাথা নাড়ল। তারপর অতিরিক্ত ব্যস্ততায় ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেল।
শুভ্ৰ কম্পিউটার খুলল। নোটবুকে লিখে রাখতে হবে অচিনবৃক্ষের ব্যাপারটা।
নিমাতলি গ্রামের অচিনবৃক্ষ দেখতে যাব। বর্ষাকালে এই বৃক্ষে সবুজ আর নীল রঙের ফুল ফোটে। এই গাছটির পাতা তেঁতুল পাতার মতো চিরল বিরল।
শুভ্রর নোট বই ভর্তি নানান পরিকল্পনা। যার কোনোটিই এখনো করা হয় নি।
বনের ভেতর আষাঢ়ি পূর্ণিমা দেখতে যাব। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সবসময় বৃষ্টি হয়। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে বনের জোছনা খুব সুন্দর হওয়া উচিত। বৃষ্টি হলেও বা ক্ষতি কী! বনের মধ্যে বৃষ্টির শব্দ শোনাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা। আচ্ছা গৌতম বুদ্ধ যে গৃহত্যাগ করেছিলেন তার সঙ্গে কি পূর্ণিমার কোনো সম্পর্ক ছিল? পূর্ণিমা কি তাঁকে গৃহত্যাগে প্রভাবিত করেছে?
বরফের দেশে জোছনা দেখতে যেতে হবে। বরফের দেশে আমি অনেকবার গিয়েছি। সবই সামারে। আমার ধারণা বরফে জোছনা খুব সুন্দর হবে। শীতের সময় জোছনার খবরাখবর নিয়ে ভুটান গেলে ভালো হবে।
শুভ্র ফাইল বন্ধ করে ইন্টারনেটে গেল। আত্রলিতার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করছে। বৃষ্টিতে ভেজার অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতাটা আত্রলিতাকে বলতে ইচ্ছা করছে।
কেমন আছ আত্রলিতা?
ভালো। খুব ভালো। অসম্ভব ভালো।
বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝামেলা মিটে গেছে?
হ্যাঁ।
দুজন একসঙ্গে কনসার্টে বাজনা বাজাচ্ছ?
হ্যাঁ।
কী বাজনা?
নাচের বাজনা ওয়াল্টজ।
তোমার আনন্দে আমি আনন্দিত।
তোমার চোখ কেমন?
এখনো দেখতে পাচ্ছি।
আজ সারাদিনের সবচে সুন্দর দৃশ্য কী?
দোলনায় দোল খেতে খেতে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য।
তোমার মা কি এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছেন?
এখনো দাঁড়ান নি। তবে দাঁড়াবেন।
তোমার প্রতি তোমার মা যে ভালোবাসা দেখাচ্ছেন, তোমার কি মনে হয় না। তাতে বাড়াবাড়ি আছে?
হ্যাঁ মনে হয়।
বাড়াবাড়ি ভালোবাসার কারণ কী তুমি জানো?
জানি।
আমাকে বলবো?
শুভ্র ক্যাপিটাল লেটারে অনেক বড় অক্ষরে লিখল- NO.
আজ নিয়ে আঠারো দিন
আজ নিয়ে আঠারো দিন পার হলো মনজু মায়া লজের এক তলায় বাস করছে। আঠারো দিনে তার কোনো ডিউটি পড়ে নি। ছোট সাহেব বাড়ি থেকে বের হন নি। সেও আটকা পড়ে আছে। তার কোথাও যাবার কোনো উপায় নেই। কখন ডাক পড়ে! মায়া লজের সামনের রাস্তার পাশে চায়ের দোকান পর্যন্ত সে যেতে পারে। ডিউটির ডাক পড়লে দারোয়ান এসে ডেকে নিয়ে যাবে। চায়ের দোকানে তো। সারাদিন বসে থাকা যায় না।
গত আঠারো দিনে তিনবার তার মনে হয়েছে– ধুত্ত্বরি! চাকরিতে পিসাব করি। আমি চললাম। যেটা মনে হয় সেটা করা কখনোই সম্ভব হয় না। চাকরিটা তার খুবই দরকার। যদিও সে সবাইকে বলে বেড়ায় বাবা-মা কেউ নেই, সেটা ঠিক না। বাবা মারা গেছেন ঠিকই। মা আছেন এবং মার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতন আছে। সৎবাবা। সৎবাবার কোনো কাজ-কর্ম নাই। তবে নানাবিধ কু-নেশা আছে। তাকে নিয়মিত গাজা খেতে হয়। গাজা খেলে শরীর ঠিক রাখার জন্যে দুধ খেতে হয়। বলকারক খাওয়া-দাওয়াও খেতে হয়। মনজুর মা রহিমা বেগম এইসব বলকারক খাওয়া এবং নেশার জোগান দেয়ার জন্যে অতি ব্যস্ত থাকেন। নিম্নশ্রেণীর এই মানুষটির প্রতি তার মার সীমাহীন মমতার (কিংবা প্ৰেম) কোনো কারণ মনজু জানে না।
মনজুর দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সবচে ভালো বিয়ে যার হয়েছে, তার স্বামী ইতালিতে জুতার দোকানে কাজ করত। যখন সব ঠিকঠাক সে তার স্ত্রী এবং দুই পুত্রকে ইতালিতে নিয়ে যাবে, তখনই খবর পাওয়া গেল বাবাজি জনৈকা স্প্যানিশ কন্যা বিয়ে করে ফেলেছে।
মনজুর সেই বোন এখন দুই বাচ্চা নিয়ে তার মার কাছে উঠে এসেছে। মনজুর সৎবাবা ইসমাইল সর্দার প্রথম কিছু দিন খুব লাফালাফি ঝাপঝাঁপি করেছেন— তালাক না দিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ? আমারে তুমি চিন না? তোমারে আমি ইতালির কুত্তার গু চেটে খাওয়াব। এম্বেসির মাধ্যমে যখন মামলা শুরু হবে, তখন পাতলা পায়খানা করতে করতে তোমার জীবন যাবে। স্ত্রীর পায়ে তো ধরবোই, দুই শিশুপুত্রের পায়ে ধরেও মাফ চাইতে হবে। ইসমাইল সর্দারের ঝাপঝাপি লাফালাফি দুই-তিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে পড়ল। তার সময় কাটতে লাগল স্বামী-পরিত্যক্ত অনজুর দুই যমজ পুত্রের সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করে। এদের সর্বশেষ খবর মনজু তার মার চিঠিতে পেয়েছে। মা লিখেছেন—
মনজু
দোয়াগো।
বাপজান, পর সংবাদ তোমার চাকরিপ্রাপ্তির সংবাদ শুনিয়া অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া। তুমি যে ভালো চাকরি পাইবে, ইহা তোমার সৎবাবা আগেই খোয়াবে পাইয়াছেন। তিনি শেষরাত্রে স্বপ্নে দেখেছিলেন তুমি অতি বৃহৎ একটি কাতল মাছ হাতে নিয়া বাড়ি ফিরিতেছ। তোমার সৎবাবা মানুষটা গাঁজা-ভাঙ যাই খাক, তাহার ভিতরে কিছু পীরাতি আছে। সাক্ষাতে তোমার সৎবাবার পীরীতির কিছু টুকটাক কথা তোমাকে বলিব। তুমি বিস্মিত হইবে।