জি মা বুঝেছি।
একটা টাওয়েল রেডি করে রাখ। শুভ্রর বৃষ্টি-বৃষ্টি খেলা শেষ হলেই নিজে উপস্থিত থেকে তাকে মাথা মোছানোর ব্যবস্থা করবে। গরম চা বানিয়ে দেবে। টাওয়েল দিয়ে মাথা পুরোপুরি শুকানো যাবে না। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাবে। কাজটা আমিই করতাম। কিন্তু আমি আগামী দুদিন ছেলের মুখ দেখব না।
মা, আপনি শুয়ে পড়ুন।
আমাকে নিয়ে তোমার ব্যস্ত হতে হবে না। ওরা যতক্ষণ বাগানে বসে। থাকবে, ততক্ষণ আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থাকব। আচ্ছা, ওরা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে?
জি-না, দেখতে পাচ্ছে না। ঘর তো অন্ধকার, এই জন্যে দেখতে পাচ্ছে না।
দেখতে পাচ্ছে না। এইটুকু বললেই হবে। কেন দেখতে পাচ্ছে না— সেই ব্যাখ্যা তোমাকে দিতে হবে না। তুমি সায়েনটিস্ট না। তুমি আইনস্টাইনের ভাতিজি না। তুমি দুই পয়সা দামের চাকরানি। এই কথাটা তো তোমার মনে থাকে না। তুমি মনে রাখবে।
সকিনা বলল, মা, আমার মনে থাকে।
জাহানারা বললেন, আবার মুখে মুখে কথা?
তিনি সকিনার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং শরীরের সব শক্তি দিয়ে তার গালে চড় মারলেন। সকিনা চমকাল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। জাহানারা খুবই স্বাভাবিক গলায় বললেন, ওরা তো কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ বসে আছে। ঠিক না সকিনা?
সকিনা জবাব দিল না। জাহানারা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তার মাইগ্রেনের ব্যথা সেরে গেছে।
বৃষ্টি কমে এসেছে। ঝিরঝির করে এখনো পড়ছে, সেটা না পড়ারই শামিল। তবে বাতাস আছে। বাতাস অসম্ভব শীতল। হাড়ে কাপন লাগিয়ে দেয়। মোতাহার হোসেন বললেন, ঠাণ্ডা কেমন দেখেছিস? এক্কেবারে সাইবেরিয়ার ঠাণ্ডা। চল উঠে পড়ি।
শুভ্ৰ জবাব দিল না। মোতাহার হোসেন বললেন, তোর যদি ঠাণ্ডা লাগে, তোর মা আমাকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে। তোর শীত লাগছে না?
শুভ্র বলল, লাগছে। আবার বসে থাকতেও ভালো লাগছে।
মোতাহার হোসেন বললেন, তাহলে বরং আরো কিছুক্ষণ বসে ঠাণ্ডা খাই। আচ্ছা শোন, আমাদের ধর্মে যে সাতটা দোজখের কথা আছে- এর মধ্যে একটা না-কি ঠাণ্ডা দোজখ?
ঠাণ্ডা দোজখ বলে কিছু নেই। তবে একটা দোজখ আছে যেখানে শারীরিক শাস্তি দেয়া হয় না। মানসিক শাস্তি দেয়া হয়।
দোজখটার নাম কী?
হোতামা।
আমার মনে হয় আমার স্থান হবে হোতামায়।
শুভ্র বলল, তুমি কোনো দোজখেই যাবে না। You are a good man. তুমি কোনো অন্যায় কর নি।
মোতাহার হোসেন বললেন, Thank you my son. আমি বড় অন্যায় আসলেই করি নি, তবে ছোটখাটো অন্যায় করেছি।
শুভ্র বলল, ছোটখাটো অন্যায় করে থাকলে বড় অন্যায়ও করেছ।
মোতাহার হোসেন বললেন, তার মানে কী?
অন্যায়ের ব্যাপারটা রিলেটিভ। আইনস্টাইনের দুটা থিওরি আছে- থিওরি অব রিলেটিভিটি এবং স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। এই থিওরি বস্তুজগতের জন্যে যেমন সত্যি, আমার ধারণা মনোজগতের জন্যেও সত্যি। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলব বাবা?
বল।
মনে কর তুমি তোমার অফিসের একজন লোককে চাকরি থেকে ছাটাই করে দিলে। তোমার দিক থেকে ছোট একটা অন্যায় করলে। চাকরি ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার কারণে লোকটা পড়ল। মহাবিপদে। সে দ্বিতীয় চাকরি জোগাড় করতে পারল না। তার ছেলেমেয়েরা না খেয়ে দিন কাটাতে শুরু করল। একটা ছেলে মারা গেল বিনা চিকিৎসায়। তার বড় মেয়েটি প্রসটিটিউট হয়ে গেল। এখন তুমি বলো, এই লোকটির কাছে তোমার সামান্য অপরাধটাই কি অনেক বড় অপরাধ না?
হ্যাঁ,
আবার তৃতীয় একজনের কাছে কী মনে হবে? এই হচ্ছে থিওরি অব রিলেটিভিটি। Absolute বলে কিছু নেই, সবই রিলেটিভ। এই আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি- এই ব্যাপারটা আমার কাছে এক রকম। তোমার কাছে আরেক রকম। আবার অন্য একজন অবজারভারের কাছে অন্য রকম।
মোতাহার হোসেন বললেন, প্রসঙ্গটা থাক।
শুভ্ৰ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা থাক।
শুভ্র টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছছে। সকিনা পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র বলল, চা খাব না।
সকিনা বলল, একটা চুমুক হলেও দিন। নয়তো মা রাগ করবেন।
শুভ্ৰ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিল। চুমুক দিয়ে বলল, মসলা চা না-কি? গরম মসলার গন্ধ। চা-টা ভালো হয়েছে। আমি পুরোটাই খাব।
সকিনা ইতস্তত করে বলল, ভাইজান, আপনাকে একটা কথা বলব। যদি রাগ না করেন।
শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, কী কথা?
সকিনা বলল, আমাদের গ্রামে একটা অদ্ভুত গাছ আছে। লোকে বলে বহু কাল আগে কুমিরের পিঠে চড়ে এক সাধু এসেছিলেন। তিনি এই গাছ পুঁতেছেন। সাত বছর পরে পরে সেই গাছে ফুল ফোটে। সবুজ আর নীল রঙের মিশাল দেয়া ফুল। আমি খবর পেয়েছি গাছে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। আমার খুবই শখ আপনারে এই গাছের ফুলগুলো দেখাব।
গাছটার নাম কী?
কেউ নাম জানে না ভাইজান। সবাই বলে অচিনবৃক্ষ।
বাহ কী সুন্দর নাম— অচিনবৃক্ষ!
সবাই বলে গাছে যখন ফুল ফুটে, তখন গাছে হাত দিয়ে আল্লাহপাকের কাছে যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়।
কত বড় গাছ?
অনেক বড় ভাইজান। রেন্টি গাছের মতো বড়। তেঁতুল গাছের পাতার মতো চিরল চিরল পাতা।
তুমি কি এই গাছের কাছে কখনো কিছু চেয়েছ? সাত বছর আগে যখন ফুল ফুটিল তখন?
ভাইজান, তখন তো আমার বিচার-বুদ্ধি ছিল না।
শুভ্র আগ্রহ নিয়ে বলল, এখন তো তোমার বিচার-বুদ্ধি হয়েছে। এখন তুমি গাছের কাছে কী চাইবে?
সকিনা জবাব দিল না। শুভ্র বলল, তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?