শুভ্র আগ্রহ নিয়ে বলল, তোমার কাছে কি বাজনার মতো মনে হয়? না-কি Noise-এর মতো লাগে?
বাজনার মতোই লাগে, তবে উল্টাপাল্টা বাজনা। তুই কি কোনো বাজনা শিখতে চাস? পিয়ানো, বেহালা?
শুভ্র বলল, না।
মোতাহার হোসেন ছেলের গায়ে হাত রাখলেন।
শুভ্র বলল, বাবা, কফি খাবে? আমার ঘরে কফি-মেশিন বসিয়েছি। এই দেখ। কফি খেতে চাইলে আমি তোমাকে এক্সপ্রেসো কফি বানিয়ে খাওয়াতে পারি। এই মেশিনে এক্সপ্রেসো কফি হয়।
কফি খাব না।
একটা ছবিতে আমি দেখেছিলাম— ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ছবির নায়ক গরম এক মগ কফি নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে কফি খাচ্ছে। ছবিটা দেখার পর আমি ঠিক করেছিলাম— কোনো একদিন যদি সিরিয়াস বৃষ্টি নামে, তাহলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কফি খাব।
মোতাহার হোসেন বললেন, ঠিক আছে, কফি খাওয়া যাক।
শুভ্র আগ্রহ নিয়ে বলল, কোথায় ভিজবে বাবা, ছাদে না বাগানে?
তোর যেখানে ইচ্ছা।
তাহলে বাগানে চল। দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে কফি-উৎসব।
AS you wish.
বৃষ্টি ভালোই নেমেছে। কফির মাগে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। শুভ্র বলল, বাবা, মগে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে কিন্তু কফি ঠাণ্ডা হচ্ছে না কেন বলে তো?
মোতাহার হোসেন বললেন, জানি না।
শুভ্র বলল, সব কিছুই রিলেটিভ। কফি যে হারে ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমরাও হচ্ছি। কাজেই টেম্পারেচার ডিফারেন্স থেকেই যাচ্ছে।
ও আচ্ছা।
বাবা, তুমি কি জানো মাঝে-মাঝে অন্ধকারেও বৃষ্টি দেখা যায়?
না জানি না।
প্রকৃতি নানান মজা করে। সমুদ্র-ফেনায় ফ্লোরেসেন্ট আলো দিয়ে দেয় বলে অন্ধকারে সমুদ্র-ফেনা দেখা যায়। একইভাবে বৃষ্টির পানিতেও হঠাৎ হঠাৎ ফ্লোরেসেন্ট দিয়ে দেয়, তখন অন্ধকারে বৃষ্টি দেখা যায়।
ও আচ্ছা।
বাবা, আমি এখন কী করছি জানো? সুন্দর সুন্দর দৃশ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছি— যাতে অন্ধ হয়ে যাবার পরেও স্মৃতি থেকে দৃশ্যগুলি দেখতে পারি।
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।
জাহানারা মাইগ্রেনের ব্যথায় কাতর হয়েছিলেন। ব্যথা প্ৰবল হলে তিনি দরজাজানালা বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। ঘর থাকে অন্ধকার। এই সময় তার ঘরে কারোরই আসার হুকুম নেই। শুধু সকিনা আসতে পারে। সে বাটি ভর্তি বরফ মেশানো পানি নিয়ে আসে। সেই হিমশীতল পানি দিয়ে তার পায়ের তালু মুছিয়ে দেয়। এতে মাইগ্রেনের ব্যথা সামান্য আরাম হয়।
সকিনা বাটি ভর্তি পানি এনেছে। পায়ের তালু মুছিয়ে দিচ্ছে। জাহানারা আরাম পাচ্ছেন। সকিনা নিচু গলায় বলল, মা, উত্তরের জানালাটা একটু খুলব? জাহানারা বিস্মিত হয়ে বললেন, বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, তুমি জানালা খুলবে কেন? তাছাড়া জানালা কেন বন্ধ করা হয়েছে তুমি জানো। মাইগ্রেনের ব্যথা উঠলে আমি জানালা বন্ধ করি। মাঝে-মাঝে তুমি যে উদ্ভট কথা বলো, আমার খুব রাগ লাগে।
সকিনা বলল, মা, আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন।
জাহানারা বললেন, হঠাৎ জানালা খোলার কথাটা তোমার মনে এসেছে কেন— এটা বলো।
জানালা খুললে একটা মজার দৃশ্য দেখতে পেতেন।
কী মজার দৃশ্য?
সকিনা জবাব দিল না। জাহানারার পায়ে হাত বুলাতে থাকল। জাহানারার ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে পা দিয়ে একটা লাথি দিতে। এই মেয়ে মাঝে-মাঝে রাগ দেখায়। রাগ দেখিয়ে কথা বন্ধ করে দেয়। তুই দুই পয়সার চাকরানি, তোর আবার রাগ কী?
সকিনা!
জি মা।
জানালা খুললে কী মজার দৃশ্য দেখব?
সকিনা জবাব দিল না। জাহানারার পায়ে ঠাণ্ডা হাত ঘষতে লাগল। জাহানারা উঠে বসতে বসতে কঠিন গলায় বললেন, যাও জানালা খোল। দেখি কী দৃশ্য। আর একটা কথা মন দিয়ে শোন সকিনা। আমি যে-কোনো দিন তোমাকে বিদায় করে দেব। তোমাকে দিয়ে আমার পোযাচ্ছে না। তুমি গাট্টি-বোচক নিয়ে চলে যাবে। যে গর্ত থেকে এসেছিলে সেই গর্তে ঢুকবে। সেটা কাল সকালেও হতে পারে, আবার একমাস পরেও হতে পারে।
জাহানারা এসে জানালার পাশে দাঁড়ালেন এবং হতভম্ব হয়ে গেলেন। শুভ্র এবং শুভ্রর বাবা দোলনায় বসে আছে। তাদের দুজনের হাতেই মগ। তারা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মাগে চুমুক দিচ্ছে। জাহানারা বললেন, কী হচ্ছে এসব?
সকিনা বলল, দুজনে মজা করছেন।
এটা কী রকম মজা? শুভ্রর বাবা কি জানে না যে শুভ্রর ঠাণ্ডার ধাত? সকিনা যাও, আমার জন্যে ছাতা নিয়ে আসা। আমি জিজ্ঞেস করব। এই ফাজলামির মানে কী?
সকিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, মজা করছে করুক না মা।
জাহানারা তীব্র গলায় বললেন, এটার নাম মজা? একে মজা বলে?
সকিনা জবাব দিল না। রাগে-দুঃখে জাহানারার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি লুকানোর চেষ্টাও করছেন না। দুজনে মিলে বৃষ্টিতে মজা করে ভিজছে, তাকে কিছু বলেও নি। তিনিও নিশ্চয়ই কফির মগ হাতে নিয়ে তাদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে পারতেন।
সকিনা! –
জি মা।
শুভ্র এবং শুভ্রর বাবা এরা আমাকে দেখতে পারে না— এটা তুমি জানো? এই বাড়িতে তোমার যে অবস্থান আমার অবস্থান তারচে আলাদা কিছু না।
শুধু শুধু মন খারাপ করবেন না মা।
শুধু শুধু মন খারাপ করছি না, আমি সত্যি কথা বলছি। আমার ছেলে সবাইকে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। রাম, শ্যাম, যদু, মধু, আধু, বন্ধু, গদু কেউ বাদ নেই, শুধু আমি বাদ।
ভাইজান ভেবেছেন। আপনি ম্যাজিক দেখলে মজা পাবেন না— এই জন্যে আপনাকে দেখান নি।
তুমি উল্টা-পাল্টা কথা বলবে না। থাপ্পর খাবে। তোমাকে ছেলের হয়ে উকালতি করতে হবে না। তুমি হাইকোর্টের ব্যারিস্টার না। তুমি দুই পয়সার চাকরানি। বুঝেছি?