জাহানারা হকচাকিয়ে গেলেন। শুভ্র বলল, কী দেখছিলে?
জাহানারা বললেন, তোকে দেখছিলাম। এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকিস কেন?
এখন ঘুমিয়ে পড়ব। ভেতরে এসো মা। গল্প করি।
গল্প করতে হবে না। ঘুমুতে যা। আচ্ছা শুভ্ৰ, তুই আয়নায় যে কবিতাটা লিখেছিস সেটা যেন কার লেখা?
রবার্ট ফ্রাষ্টের।
যে লিপস্টিক দিয়ে কবিতাটা লিখেছিস সেটা কোথায়?
শুভ্র বলল, লিপষ্টিক দিয়ে লিখি নি তো মা! ক্ৰেয়ন দিয়ে লিখেছি। কেন বলে তো?
আমাকে দিস তো! আমিও মাঝে মাঝে আয়নায় লিখব।
এসো, নিয়ে যাও।
জাহানারা চাররঙের চারটা ক্ৰেয়ন নিয়ে নিজের ঘরে ফিরলেন। সবুজ রঙ দিয়ে আয়নায় লিখলেন— শুভ্ৰ, তুই এত ভালো কেন?
সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে মেঘ
সারাদিন আকাশে মেঘের ছিটেফোটাও ছিল না। সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে মেঘ করল। বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করল রাত আটটা থেকে। একেকবার বাতাসের ঝাপ্টা আসে, বাগানের লোহার দোলনা দুলে উঠে কটকট শব্দ হয়। শহরের বাড়ি-ঘরে বৃষ্টির শব্দ পাওয়া যায় না। মায়া লজে পাওয়া যায়। টিনের চালে বৃষ্টির যে শব্দ ওঠে, কোনো এক অদ্ভুত কারণে এ বাড়িতেও ওঠে।
মোতাহার হোসেন শুভ্রর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরের সবকটিা জানালা খোলা। বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির ছাট ঘরে ঢুকছে। শুভ্র বসে আছে কম্পিউটারের সামনে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে। বাইরের ঝড়-বৃষ্টির খবরই হয়তো সে জানে না। মোতাহার হোসেন খুশি খুশি গলায় বললেন, Hello young man!
শুভ্ৰ কম্পিউটার থেকে চোখ ফেরাল বাবার দিকে। তার মুখও হাসি হাসি। সে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, Hello old man and the sea!
মোতাহার হোসেন বললেন, সিরিয়াস বৃষ্টি-বাদলার দিনে তুই কম্পিউটারের সামনে বসে আছিস কেন?
শুভ্র বলল, বৃষ্টি-বাদলার দিনে আমার কী করা উচিত?
বৃষ্টিতে ভিজবি? আয় বৃষ্টিতে ভিজি। আগে কম্পিউটার অফ কর। বৃষ্টির সঙ্গে কম্পিউটার যায় না।
শুভ্ৰ কম্পিউটার অফ করতে করতে বলল, বাবা, ভেতরে এসো। গল্প করি। মোতাহার হোসেন ঘরে ঢুকলেন। ছেলের মুখোমুখি না বসে তার পাশে বসলেন। পাশাপাশি বসলে মাঝে-মধ্যে ছেলের গায়ে হাত রেখে কথা বলা যায়। মুখোমুখি বসলে সেটা সম্ভব হয় না।
শুভ্ৰ! জ্বি বাবা।
প্রবল বৃষ্টিকে ইংরেজিতে বলে Raining cats and dogs. কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক কী তুই জানিস?
শুভ্র বলল, কুকুর এবং বিড়াল- এরা হলো একজন আরেকজনের শত্রু। এরা যখন ঝগড়া শুরু করে, তখন একজন অন্যজনের উপর প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই জন্যেই প্রবল বেগের বৃষ্টি হলো ক্যাটস অ্যান্ড ডগস।
মোতাহার হোসেন মুগ্ধ গলায় বললেন, এমন কোনো বিষয় কি আছে যা তোর জানা নেই?
শুভ্র বলল, তুমি এত মুগ্ধ হয়ো না। বাবা। Cats and Dogs-এর যে ব্যাখ্যাটা দিয়েছি সেটা বানিয়ে দিয়েছি। আমি আসল ব্যাখ্যা জানি না।
তুই জানিস না?
না।
ব্যাখ্যাটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং। আমার পছন্দ হয়েছে। তোর মা যে তোর উপর ভয়ঙ্কর রেগে আছে— এটা কি তুই জানিস? তুই না-কি ম্যাজিকের কথা বলে একটা দড়ি কেটে তার হাতে দিয়ে দিয়েছিস? দড়ি যে-রকম ছিল সে-রকম আছে। সে খুবই অপমানিত বোধ করছে। হা-হা-হা।
মার অপমান হয়েছে- তুমি তাতে এত খুশি কেন?
তাকে বোকা বানানো গেছে— এতেই মনে হয়। আমি খুশি।
শুভ্র বলল, মাকে বোকা বানানোর তো কিছু নেই। বেচারি তো বোকাই।
মোতাহার হোসেন আগ্রহ নিয়ে বললেন, তোর মা বোকা?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ।
বুদ্ধির স্কেল যদি এক থেকে দশ হয়, তুই তোর মাকে কত দিবি?
তিন দেব।
আর আমাকে?
তোমাকে নয় দেব।
নয় কেন? দিশ না কেন?
শুভ্র বলল, নিজের বুদ্ধি নিয়ে তোমার অহঙ্কার আছে, এই জন্যেই এক পয়েন্ট কাটলাম। যাদের বুদ্ধি দশে দশ— তারা তাদের বুদ্ধি নিয়ে অহঙ্কার করবে না। অস্বস্তি বোধ করবে।
অস্বস্তি বোধ করবে। কেন?
বুদ্ধি বেশি কেন— এই নিয়ে অস্বস্তি।
তোর বুদ্ধি কি দশে দশ?
হ্যাঁ।
তোর কথার মধ্যেও তো অহঙ্কার প্রকাশ পাচ্ছে।
তুমি জিজ্ঞেস করেছ বলেই অহঙ্কারের কথাটা বলেছি। জিজ্ঞেস না করলে বলতাম না।
তোর বুদ্ধি যে দশে দশ- তার কিছু প্রমাণ দে।
শুভ্র বলল, যে আমাকে যে-রকম দেখতে চায়, আমি তার কাছে সে-রকম থাকি। মা আমাকে একটা অসহায় ছেলে হিসেবে দেখতে চায়, যে ছেলে নিজের কোনো কাজই গুছিয়ে করতে পারে না। দাঁত ব্ৰাশ করে টুথপেস্টের মুখ লাগাতে ভুলে যায়। বাইরে বের হবার সময় চুল আঁচড়াতে ভুলে যায়। রোজ শেভ করার কথা ভুলে যায়। মাকে খুশি করার জন্যে এই কাজগুলি আমি ইচ্ছা করে করি। আর তুমি আমাকে একজন সুপার ইন্টেলিজেন্ট ছেলে হিসেবে দেখতে চাও! এখন তুমিই বলো, তোমার কাছে কি আমি সুপার ইন্টেলিজেন্ট ছেলে হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করি নি?
তুই বলতে চাচ্ছিস যে, তুই আসলে ইন্টেলিজেন্ট না, অথচ ভান করছিস ইন্টেলিজেন্ট। ইন্টেলিজেন্স কি ভান করা যায়?
একেবারেই যে করা যায় না তা-না। স্যার আলেক গিনিসের মতো বড় অভিনেতারা বোকার অভিনয় যেমন করতে পারেন, বুদ্ধিমানের অভিনয়ও পারেন। পারেন না?
সেই ক্ষেত্রে তোকে আমি অভিনয়ে দশে দশ দিতে পারি। বুদ্ধিতে কেন দেব?
শুভ্র বলল, আচ্ছা দিও না। মোতাহার হোসেন বললেন, রোজ সকালে তুই কম্পিউটারে কি বাজনা বাজাস?