জি-না।
বাড়ির চারদিকে বিরাট বাগান আছে। বাগানে ঘুরতে চাইলে ঘুরতে পার, শুধু রাত বারটার পরে না। রাত বারটার পরে কুত্তা ছেড়ে দেয়া হয়। স্যারের দুটা কুত্তা আছে- সরাইলের কুত্তা। ভয়ঙ্কর। কুত্তার সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করানো হয়েছে?
জি-না।
যাও গার্ডের কাছে যাও, সে পরিচয় করায়ে দেবে। তোমার গায়ের গন্ধ শুকাবে। কুকুরের স্মৃতিশক্তি ভালো। একবার কারোর গায়ের গন্ধ শুকলে বাকি জীবন মনে রাখে। তারপরেও প্রথম এক সপ্তাহ রোজ তোমার গায়ের গন্ধ শুকায়ে আসবে। এদের নামও মনে রাখবে। একজনের নাম টুং, আরেকজনের নাম টাং।
কুকুরের নাম টুং টাং?
ছোট সাহেব নাম রেখেছেন। কুকুর দুটাই নিজেদের নাম খুব ভালো মতো চেনে। টুং ডাকলে টুং ছুটে আসে, টাং ডাকলে টাং ছুটে আসে। তোমার কি আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?
জি-না।
আমাদের এইখানের নিয়মে মাসে দুই দিন ছুটি। ছুটি কবে নিতে হবে সেটা আগেই বলে দিতে হবে। ইচ্ছা করলে ছুটি জমাতে পার। কোনো মাসে যদি ছুটি না নাও তাহলে পরের মাসে চারদিন ছুটি পাবে। এই বাড়িতে চাকরির আরাম আছে। ভালো আরাম।
মনজু বলল, আপনাকে কী ডাকব?
রহমুতুল্লাহ বললেন, যা ইচ্ছা হয় ডাকবে, শুধু স্যার ডাকবে না। আমরা এখানে শুধু বড় সাহেবকে স্যার ডাকি।
চাচাজি ডাকব?
ডাকতে পার। ও আচ্ছা, আরেকটা কথা তো বলতে ভুলে গেছি। মাসে এক দুই দিন আমার শরাব খাওয়ার অভ্যাস আছে। সবাই জানে। বড় স্যারও জানেন। মাতাল অবস্থায় একদিন উনার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। উনি কিছু বলেন নাই। যাই হোক আসল কথা হচ্ছে— ফিস্টের রাতে একতলার লোকজন চান্দা তুলে আমাকে একটা বোতল কিনে দেয়। বোতল কেনার চান্দা তুমিও দিবে। তোমার ভাগে ত্ৰিশ চল্লিশ টাকার বেশি পড়বে না।
মনজু বলল, জ্বি আচ্ছা।
তোমার কি এইসব অভ্যাস আছে?
জি-না।
না থাকাই ভালো। অতি বদঅভ্যাস। আমি হজু করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হজ্বের পর তওবা করে এইসব ছেড়ে দেব।
জাহানারা ছেলের ঘরে এসে বসেছেন। শুভ্ৰ হাসিমুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে, তবে সে মাকে দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তার চোখে চশমা নেই। সে দেখছে। নাক-মুখবিহীন ফর্সা একটা গোলাকার মুখ। শুভ্র বলল, মা, তুমি কেমন আছ?
জাহানারা বললেন, আমি কেমন আছি তা দিয়ে তো তোর কোনো দরকার নেই। আমাকে ছাড়াই তো তুই সুখে আছিস। আমি একবার পনেরো ঘণ্টা তোর সঙ্গে কথা বলি নি। তুই বুঝতেই পারিস নি।
শুভ্র বলল, বুঝতে পারব না কেন। ঠিকই বুঝেছি। আমি ভাবলাম কোনো কারণে তুমি কারো সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না। একা একা থাকতে চাচ্ছি। তাই তোমাকে বিরক্ত করি নি।
ছেলেটাকে কেমন দেখলি?
কোন ছেলেটা?
ঐ যে তোর সঙ্গে সঙ্গে যে ঘুরবে। তোর টেক কেয়ার করবে। মিজান না। কী যেন নাম।
ও, মনজুর কথা বলছ? ভালো ছেলে। বুদ্ধিমান, সরল সোজা।
তোর কাছে তো সবাই বুদ্ধিমান। সবাই সরল সোজা। ও তোর কাছ থেকে হাতে মুঠো করে কী নিয়ে যাচ্ছিল?
দড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, দড়ি নিয়ে যাচ্ছিল মানে কী?
মানে হলো মা, আমি ওকে একটা ম্যাজিক দেখাচ্ছিলাম। চায়নিজ রোপ ট্রিক। একটা দড়ি কেটে দু টুকরা করে তার হাতে দিয়েছি। দশ মিনিট মুঠো বন্ধ করে রাখলে কাটা দড়ি জোড়া লেগে যায়। এই ট্ৰিক।
জোড়া লেগেছে?
জানি না জোড়া লেগেছে কি-না। তার সঙ্গে পরে আমার আর দেখা হয় নি।
তুই দুনিয়ার সবাইকে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াচ্ছিস, কই আমাকে তো এখনো দেখালি না।
এইসব ব্যাপারে তোমার আগ্রহ নেই, সেই জন্যে তোমাকে দেখাই নি।
আগ্রহ নেই তোকে কে বলল? ছোটবেলায় কত ম্যাজিক দেখেছি। আমি নিজেও একটা ম্যাজিক পারতাম- রাবারব্যান্ড দিয়ে করতে হয়। এখন অবশ্যি ভুলে গেছি। দেখি তুই আমাকে একটা ম্যাজিক দেখা। ঐ ছোড়াটাকে যেটা দেখিয়েছিস সেটা না। অন্য কিছু।
অন্য কিছু তো মা পারব না। আমি একটাই ভালোমতো শিখেছি। কাটা দড়ি জোড়া লাগানো। এটা দেখাব?
আচ্ছা দেখা।
তাহলে মা তুমি চট করে বাথরুমে যাও। কাঁচিটা নিয়ে আস। জাহানারা ছেলের বাথরুমে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলেন। বাথরুমের আয়নায় বড় বড় করে একটা ইংরেজি কবিতা লেখা। কবিতাটা লেখা হয়েছে লাল লিপস্টিক দিয়ে। শুভ্ৰ লিপস্টিক পাবে কোথায়? তিনি কয়েকবার কবিতাটা পড়লেন। যে লিপস্টিক দিয়ে কবিতাটা লেখা হয়েছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। লিপস্টিক পাওয়া গেল না।
বাথরুমের আয়নায় লেখা
I often see flowers from a passing car
That are gone before I can tell what they are.
Heaven gives its glimpses only to those
Not in position to look too close.
জাহানারা কাঁচি হাতে ছেলের সামনে বসলেন। ম্যাজিকে এখন তার মন নেই। তার মাথায় ঘুরছে বাথরুমের আয়নায় লেখা কবিতা। যে লিপস্টিক দিয়ে কবিতাটা লেখা হয়েছে সেই লিপষ্টিক।
জাহানারা বললেন, বাথরুমের আয়নায় হাবিজাবি এইসব কী লিখেছিস?
শুভ্র বলল, রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতার প্রথম দু লাইন এবং শেষ দু লাইন।
মানে কী?
শুভ্র বলল, মানে হচ্ছে যে মানুষ গভীর আগ্রহে কিছু দেখতে চায় প্রকৃতি তাকে দেখায়, তবে খুব সামান্যই দেখায়।
জাহানারা বললেন, কিছুই তো বুঝলাম না। আচ্ছা বাদ দে। আমার কবিতা বোঝার দরকার নেই। তুই কী দেখাবি দেখা।
শুভ্র বলল, এই দেখ মা, দেড় ফুট লম্বা একটা দড়ি। তুমি মাঝখান দিয়ে কেটে দাও। এখন বলো— দুটুকরা হয়েছে না? এখন এই দুটা টুকরা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের ঘরে যাও। ঘড়ি দেখে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে মুঠো খুলবে। দেখবে দড়ি জোড়া লেগে গেছে।