তুমি আমার সঙ্গে শুরুতে যে চালাকি করেছ, সে-রকম চালাকি আমার ছেলের সঙ্গে করবে না। শুভ্র চালাকি ধরতে পারে না।
মনজু বলল, স্যার, মানুষ ভুল একবারই করে।
মোতাহার হোসেন বললেন, মানুষ বার বারই ভুল করে। তুমিও করবে। তবে মনে রেখ— আমার ছেলের সঙ্গে যদি কোনো ভুল কর আমি তোমাকে কঠিন শাস্তি দেব।
মনজু বলল, স্যার ভুল হবে না। মোতাহার হোসেন বললেন, এখন কানে ধর। মনজু হতভম্ব হয়ে তাকাল। এই শুয়োর কী বলে? আমি কানো ধরব কী জন্যে?
মোতাহার হোসেন বললেন, আমার সঙ্গে যে চালাকি করেছ তার শাস্তি হিসেবে আমি না বলা পর্যন্ত তুমি কানো ধর উঠবোস করতে থাকবে। চাকরি পাবার এটা হলো পূর্বশর্ত।
মনজু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এটা কি কোনো ঠাট্টা? কোনো রসিকতা? মোতাহার হোসেনও তাকিয়ে আছেন। তার চোখের দৃষ্টি শান্ত। শান্ত দৃষ্টি বলে দিচ্ছে মনজুকে ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরি নিতে হলে সত্যি সত্যি তাকে কানে ধরে উঠবোস করতে হবে। এটা কি আসলেই সম্ভব? রাস্তায় ভিক্ষুকদের সঙ্গে পড়ে থাকলেও সম্ভব না। মনজুর বাবা একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। গ্রামে তিনি সম্মান নিয়ে বাস করেছেন। বাবার পুরনো ছাত্রের সঙ্গে যখন দেখা হয় তারা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলে, তুমি জালাল সাহেবের ছেলে। তোমার বাবা তো ফেরেশতার মতো মানুষ ছিলেন।
মনজু কানে ধরে উঠবোস করছে। এর মধ্যেই মোতাহার হোসেন অফিসের ম্যানেজারকে ডেকেছেন। ম্যানেজারকে খুবই সহজ ভঙ্গিতে বলেছেন- এই ছেলেটাকে একটা অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার দাও। বেতন সব মিলিয়ে ছয় হাজার টাকা। আজ তাকে এক মাসের বেতন অ্যাডভান্স দেবে। মনে হয় টাকা তার খুবই দরকার। মাসে মাসে কেটে রাখবে।
মনজু যাত্রাবাড়িতে ফিরল রাত আটটায়। সে তার মামির জন্যে সবুজ রঙের একটা শাড়ি, ইকবাল সাহেবের জন্যে সিল্কের পাঞ্জাবি কিনে এনেছে। বাজারের বড় ব্যাগে করে দুই কেজি খাসির মাংস, একটা ইলিশ মাছ, পোলাওয়ের চাল এবং ঘি এনেছে। দই এবং এক কেজি কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই এনেছে। রাতে যাতে মামার বাসায় আজ ভালো খাওয়া-দাওয়া হয়।
রুনু সব দেখে অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?
মনজু বলল, বড় সাহেব জাপান থেকে ফিরেছেন। আমার ঢাকাতেই পোস্টিং হয়েছে। আমি কাল ভোরবেলা কাজে জয়েন করব।
রুনু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
মনজু তার মামির পা ছুঁয়ে বলল, মা, আপনার জন্যে শাড়িটা এনেছি। আমার নিজের মা আমার তিন বছর বয়সে মারা গেছেন। তাকে কিছু দিতে পারি নি। আপনাকে দিলাম।
কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। মনজুর বাবা নেই, তবে মা বেঁচে আছেন। বিয়ে শাদিও করেছেন।
মনজুর মামি এতই খুশি হলেন যে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি বললেন, তুমি কাল সকালে চলে যাবে। এইসব কী বলছ? তুমি আমার এইখানেই থাকবে।
মনজু বলল, আমি মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাব। কোম্পানি আমাকে থাকার জায়গা দিয়েছে। আমাকে সেইখানেই থাকতে হবে।
বাড়িতে রান্নার বিপুল আয়োজন চলছে। ইকবাল সাহেব গেছেন দোকান থেকে ঠাণ্ডা কোক আনতে। ফিস্টটা যেন সৰ্বাঙ্গ সুন্দর হয়। নতুন পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে গিয়েছেন। পাঞ্জাবিটা সুন্দর ফিট করেছে।
মনজু বসার ঘরে একা বসে আছে। রুনু এক সময় বসার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল— মনজু ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। রুনু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
মনজু বলল, আমি আজ খুবই মনে কষ্ট পেয়েছি। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
রুনু বলল, ঘটনাটা বলবেন?
মনজু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, একজন আমাকে সবার সামনে কানে ধরে উঠবোস করিয়েছে।
রুনু বলল, সেই একজনটা কে?
মনজু জবাব দিল না। শব্দ করে কাঁদতে লাগল। রুনু গিয়ে তার মাকে ডেকে নিয়ে এলো। তিনি এসে মনজুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন।
মায়া লজের দোতলার বারান্দা
মনজু মায়া লজের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনি যে ছোট সাহেবের মা, এই বাড়ির কত্রী– তা কেউ না বলে দিলেও বোঝা যায়। ভদ্রমহিলার মুখটা ছোট এবং নিখুঁত গোলাকার বলেই মুখে বিড়াল বিড়াল ভাব চলে এসেছে। পরেছেন কালো সিস্কের শাড়ি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা সাদা-কালো বিড়াল বসে ফোস ফোস করছে। তার সামনে একটা টেবিল। টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ার আছে। মনজু খালি চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বসতে বলা হয় নি। তাকে বসতে বলা হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও সে দেখছে না। ভদ্রমহিলা তাকে চাকরিবোকর হিসেবেই দেখছেন।
তোমার নাম কী বললে?
মনজু!
মনজু না মজনু? স্পষ্ট করে বলো। বিড়বিড় করছি কেন?
ম্যাডাম আমার নাম মনজু।
জাহানারা টেবিলে রাখা চশমা চোখে দিলেন। পরীক্ষকের ভঙ্গিতে তাকালেন। তাকে দেখে মনে হলো না মনজুকে তার পছন্দ হয়েছে।
দেশের বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনা।
জাহানারা হতাশ গলায় বললেন, বুঝেছি— আইছুন খাইছুনের দেশ। শোন ছেলে, শুভ্রর সঙ্গে এ জাতীয় ভাষা ব্যবহার করবে না। পরে দেখা যাবে সেও আইছুন খাইছুন শুরু করেছে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে, বুঝেছ?
জি আচ্ছা ম্যাডাম।
আজ আমার শরীরটা খারাপ বলে তোমাকে উপরে ডেকে পাঠিয়েছি। তোমার জায়গা হচ্ছে একতলা। সেখানেই থাকবে, উপরে আসবে না। শুভ্রর ঘরে তোমার যাবার দরকার নেই। বুঝেছ?
জি।
তুমি সবসময় একটা হ্যান্ডব্যাগ ক্যারি করবে। সেখানে শুভ্রর জন্যে বাড়তি চশমা রাখবে। শুভ্রর চোখ খারাপ জানো তো?