মনজু বলেছে, রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে হ্যাচোড় প্যাচোড় করা তোমার মতো মেয়ের পক্ষে সম্ভব না। আমি আছি কী জন্যে?
রুনু বলল, আপনি তো আর সারা জীবন থাকবেন না। তখন কী হবে? নাকি আপনার দীর্ঘ পরিকল্পনা?
এই বলেই মেয়ে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল। চোখের দৃষ্টি দেখেই মনজুর খবর হয়ে গেল। এই মেয়ে সহজ পাত্র না। এর ক্যাচাল আছে। মনজু বলল, আমি আর এক দুই দিনের বেশি আছি বলে মনে হয় না। আজ ঢাকা অফিসে খোঁজ করব। বড় স্যার যদি জাপান থেকে আজ চলে আসেন তাহলে কালকেই আমাকে চিটাগাং রওনা হতে হবে।
রুনু বলল, আপনার পোস্টিং কি চিটাগাং-এ?
মনজু বলল, চিটাগাং-এ হবার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের কোম্পানির ইংল্যান্ডেও অফিস আছে। আবার কাছের দেশ সিঙ্গাপুরেও আছে। আমাকে তো আর শুরুতেই বিদেশে পোস্টিং দিবে না।
রুনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে আমার ভালো লাগে না।
মনজুর বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগলেও সে উদাস গলায় বলার চেষ্টা করল, কোনটা মিথ্যা?
রুনু বলল, আপনি যা বলছেন সবই মিথ্যা। আপনি ঢাকায় এসেছেন চাকরির খোজে। আপনার ইচ্ছা নানান ধরনের মিথ্যা-টিথ্যা বলে যতদিন সম্ভব আমাদের বাড়িতে থাকা। যখন আর থাকতে পারবেন না। তখন আরো একটা বড় মিথ্যা বলে অন্য কোথাও যাবেন। সেখানেও মিথ্যা বলবেন।
এই তোমার ধারণা?
ধারণা না, এটাই সত্যি। বাবা-মা দুজনই সোজা সরল মানুষ বলে আপনার মিথ্যাগুলি ধরতে পারছেন না।
তুমি মহাচালাক বলে ধরে ফেলেছ?
রুনু স্পষ্ট করে বলল, হ্যাঁ। তবে আপনার ভয় নেই, আপনার মিথ্যা আমি বাবা-মাকে ধরিয়ে দেব না। আপনি তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে যতদিন ইচ্ছা আমাদের বাড়িতে থাকতে পারেন।
আমার প্রতি তোমার এত দয়ার কারণ কী? আপনি মহাবিপদে পড়েছেন, এই জন্যেই আপনার প্রতি আমার দয়া।
ভালো। অন্তত একজন নিজের মানুষ থাকল। মেয়েটা হৃদয়হীনা না। মায়া-মমতা আছে। মনজু সত্যি কথা বলতে শুরু করার আগেই রিকশা পাওয়া গেল। রুনু রিকশায় উঠতে উঠতে আবারো বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে আমার ভালো লাগে না।
মনজু মনে মনে বলল, এই পুচকি, তোর ভালো লাগার উপরে দুনিয়া চলবে না। এই দুনিয়ায় সত্য-মিথ্যা দুই ভাই। দুনিয়া চলে দুই ভাইয়ের ইশারায়। তুই আরেকটু বড় হ। প্রেমে ফ্রেমে পড়। তারপর দেখবি কী রকম হড়বড় করে মিথ্যা বলবি। তখন একটা সত্যি কথা বললে বিশটা বলবি মিথ্যা।
মামা-ভাগ্নে সিগারেটের পর মনজু আরেকটা সিগারেট ধরাল। এই সিগারেটের নাম চিন্তা সিগারেট। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সিগারেট। চিন্তা সিগারেট এক জায়গায় বসে টানার সিগারেট না। এই সিগারেট হাঁটাহাটি করতে করতে টানতে হয়।
এখন মনজুর প্রধান চিন্তা সে কী করবে? মেগাবাস তাকে বসতে বলেছিলেন। সে কি অফিসে ফিরে যাবে? মেগাবাস যদি তাকে পুলিশে দিতে চাইতেন তাহলে তখনই দিতে পারতেন। বসতে বলতেন না। লাক ট্রাই করতে অসুবিধা কী? মেগাবাস যদি তাকে ডেকে পাঠান। তাহলে সে বলবে- স্যার, আপনার কাছ থেকে খালি হাতে যদি ফিরি। তাহলে মৃত্যু ছাড়া আমার পথ নেই। এই দেখেন স্যার, আমি বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট কিনে পকেটে রেখে দিয়েছি। এক পাতা ঘুমের ট্যাবলেট কিনতে কত টাকা লাগবে কে জানে। তার কাছে এই মুহুর্তে আছে সাতান্ন টাকা এবং সাতটা সিগারেট। সাতটা সিগারেটে আজকের দিন চলবে না। আরেক প্যাকেট কিনতে হবে। ঘুমের ওষুধ কেনার চিন্তা বাদ দিতে হবে। মেগাবাসকে অন্য কিছু বলতে হবে। যেমন… স্যার, আপনার কাছ থেকে যদি খালি হাতে ফিরি। তাহলে চলন্ত ট্রাণের সামনে লোফ দিয়ে পড়া ছাড়া আমার পথ নেই।
মোতাহার হোসেন মনজুকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মনজু এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে একমনে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে। মহাবিপদের সময় এই দোয়া পড়তে হয়। তার কাছে মনে হচ্ছে সে মহাবিপদেই আছে।
মনজু!
জি স্যার।
আমার ছেলের নাম তুমি জানো। শুভ্ৰ! চিঠিতে এই নামের উল্লেখ আছে। আমার ছেলেটা শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই অন্য দশজনের থেকে আলাদা। তার চোখ খুব খারাপ। চশমা পরেও সে যে খুব ভালো দেখে তা আমার মনে হয় না।
মনজু মনে মনে বলল, বক্তৃতা বন্ধ করে আসল কথা বল। তোর ছেলে চোখে দেখে না তাতে আমার কী? সে আন্ধা হয়ে গেলেও কোনো সমস্যা নাই। বাপের টাকার বিছানায় হাগা-মুতা করবে। দশটা থাকবে নার্স। প্রত্যেকটা দেখতে সুন্দর। এরা তোর ছেলেকে শুচু করাবে।
মোতাহার হোসেন বললেন, চোখের সমস্যা ছাড়াও তার শরীর দুর্বল। ছোটবেলা থেকেই অসুখবিসুখে ভোগে। তার মা তাকে আলাদা করে বড় করেছেন বলে পৃথিবীর জটিলতা সে কিছুই জানে না। তার জগৎটা হলো বইপত্রের। সে দিনরাত বই পড়ে। আমি আমার ছেলের জন্যে একজন সার্বক্ষণিক চালাক চতুর সঙ্গী খুঁজছি। শুভ্র যখন বাইরে যাবে ওই সঙ্গী থাকবে তার সঙ্গে।
আমার চেহারা কি দেখতে চাকরের মতো? তুই কি আমাকে টাকার গরম দেখাস?
মনজু!
জি স্যার।
তুমি চালাক ছেলে। তোমার মতোই একজনকে আমার দরকার। করবে এই চাকরি?
স্যার, বেতন কী?
যদি চাকরি কর— তুমি থাকবে আমার ওয়ারির বাড়িতে। খাওয়াদাওয়া ফ্রি। মাসে তোমাকে ছয় হাজার করে টাকা দেয়া হবে। অফিসের অন্যান্য সুবিধা যা আছে পাবে। করতে চাও এই চাকরি?
জি স্যার। অবশ্যই করব।