মেগাবাস তাকে থাকতে বলেছেন। কেন বলেছেন বোঝা যাচ্ছে না। কোলে বসিয়ে আদর করার জন্যে নিশ্চয়ই থাকতে বলেন নি। কিছুক্ষণ শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করলেন। মাথার ঘাণ নিলেন। তারপর বললেন, বাবা যাও আজ থেকে চাকরিতে জয়েন কর। মাসে বেতন পাঁচ হাজার টাকা। কোয়াটার ফ্রি, মেডিকেল ফ্রি। দুই ঈদে ফুল বোনাস। যাতায়াতের জন্যে কোম্পানি থেকে গাড়ি পাবে। আর বাবা শোন, দুপুরে আমার সঙ্গে খাও। আমি আবার একা খানা খেতে পারি না।
মনজুর ধারণা মেগাবাস তাকে থাকতে বলেছেন পুলিশের হাতে তুলে দেবার জন্যে। এইসব অতি বড়লোকদের সঙ্গে থানাওয়ালদের খুব খাতির থাকে। খবর দিলেই ওসি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। দাত কেলিয়ে বলেন, স্যার, আপনার জন্যে কী করতে পারি? সমস্যা কী হয়েছে বলেন। ঠিক করে দিয়ে যাই।
ওসি সাহেব এই ধরনের কথা বললে মেগাবাস বলবেন, এই ছেলেটাকে থানায় নিয়ে যান। আমার সঙ্গে ফ্রিডবাজি করতে এসেছে। দুএক রাত হাজতে রেখে দেন। তাহলে ঠিক হয়ে যাবে। সমাজের একটা উপকার হবে।
থানাওয়ালারা সমাজের উপকারের জন্যে মোটেই ব্যস্ত না, তবে মেগাবসের কথা বলে কথা।
মনজুর চা খাওয়া হয়েছে। মামা-ভাগ্নে সিগারেট খাওয়াও হয়েছে। এখন সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মেগাবাস তাকে থাকতে বলেছেন বলেই বোকামি করে অফিসে ঢুকে পুলিশের কাছে ধরা খাওয়ার কোনো মানে হয় না। ভদ্রলোক যে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, পুলিশের হাতে কখনো ধরা পড়েছি, হাজত খেটেছ? এই প্রশ্নের মানে একটাই- হাজত খেটে দেখ কেমন লাগে।
এখন সে কী করবে? যাত্রাবাড়িতে ফিরে যাবে? গত সাতদিন ধরে সে যাত্রাবাড়িতে আছে। তার মামা ইকবাল সাহেবের বাড়িতে। আপন মামা না। তার বড় মামির ছোট ভাই। লতায়পাতায় মামা। ভদ্রলোক এজি অফিসের সিনিয়ার অ্যাসিসটেন্ট। ভালো মানুষ টাইপ জিনিশ। মুখের উপর বলতে পারছেন নাএক সপ্তাহ হয়ে গেল। আর কতদিন থাকবে? মুখের উপর বলতে না পারলেও
দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন আসলে আমার ভালো লাগে। আত্মীয়স্বজন ছাড়া বাঙালির আছে কী। এই যে কথায় আছে- এক লতায় টান দিলে দশ লতা নড়ে। চৈত্র মাসে মেঘ করে বৈশাখ মাসে পড়ে। তবে সমস্যা হলো আমার অতি ছোট বাসা। একটা বাথরুম। রুনু ইন্টারমিডিয়েট দিবে- নিরিবিলি ছাড়া পড়তে পারে না।
মনজু মামার কথা শেষ হবার আগেই বলেছে, অবশ্যই অবশ্যই। মামা, আপনি অতি ভালোমানুষ বলেই আত্মীয়স্বজনের অত্যাচার সহ্য করেন। আমি আপনার জায়গায় হলে দরজায় নোটিশ ঝুলিয়ে রাখতাম— আত্মীয়স্বজন! পথ দেখো। সিন্দাবাদের ভূতের মতো আত্মীয়স্বজন কাঁধে নিয়ে দিনের পর দিন পার করা উচিত না। একেবারেই উচিত না। এটা আসলে ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে। ফৌজদারি ক্রাইম।
মনজু তার নিজের ব্যাপারে ছোট্ট একটা চাল চেলেছে। সে বলেছে— সে ঢাকায় এসেছে, কারণ এম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মোতাহার হোসেন সাহেব তাকে একটা চাকরি দিয়েছেন। মাসিক বেতন দশ হাজার টাকা। অ্যাপিয়েন্টমেন্ট টঙ্গি না চিটিাগাং এটা জানতে পারছে না বলে চাকরিতে জয়েন করতে পারছে না। কারণ মোতাহার সাহেব চলে গেছেন জাপানে। এক দুই দিনের মধ্যে তার ফেরার কথা। এই মিথ্যা বলার কারণ কিছু না, নিজের দাম সামান্য বাড়ানো। বেকার একটা ছেলেকে বাড়িতে পোষা এক কথা আর দশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি আছে এমন একজনকে পোষা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
ইকবাল সাহেবের স্ত্রী স্বামীর মতোই বোকাসোকা মানুষ। তাকে কায়দা করতে মনজুর মোটেই বেগ পেতে হয় নি। প্রথম দিন থেকেই মনজু তাকে মা ডাকছে। কারণ এই ভদ্রমহিলা না-কি অবিকল তার মৃতা মায়ের মতো।
মনজু কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছে, মা, আপনাকে আমি তাঁর ছবি দেখাব। ছবি দেখালে বুঝবেন আমার কথা কতটুকু সত্যি কতটুকু মিথ্যা। আপনার চেহারা যে শুধু আমার মার মতো তা-না, আপনার চালচলন কথাবার্তাও আমার মার মতো। আমার মার মতোই আপনি নরম স্বভাবের। তবে আমার মা আপনার মতো সুন্দরী ছিলেন না। আপনার গায়ের রঙ তো আগুনের মতো। আমার মা ছিলেন শ্যামলা।
ভদ্রমহিলা খুবই খুশি হয়ে গেলেন। লাজুক গলায় বললেন, কী যে তুমি বলো! আমার আবার গায়ের রঙ। গায়ের রঙ ময়লা বলে বিয়েই হচ্ছিল না।
মনজু চোখ কপালে তুলে বলেছেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! মা, আপনি এইসব কী বলেন? আপনার গায়ের রঙ ময়লা!
রঙ আরো ভালো ছিল। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় টাইফয়েড হলো, তখন রঙ নষ্ট হয়ে গেল।
নষ্ট হবার পরে এই অবস্থা? ইয়া গাফুরুর রহিম। মা শুনেন, কাজের কথা বলি। আমি বাইরের একজন মানুষ, আপনাদের ছোট্ট সংসারে উপদ্রবের মতো উপস্থিত হয়েছি। দুএক দিনের মধ্যে আমরা পোস্টিং হবে। মনে হচ্ছে চিটাগাং নিয়ে ফেলবে। আমাদের মূল অফিস চিটাগাং-এ। এই দু একদিন আমি আপনাদের বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকব। যদি অনুমতি দেন।
অবশ্যই থাকবে। অনুমতির কী আছে?
আরেকটা কথা মা— যদি চিটাগাং-এ পোস্টিং হয় তাহলে কিন্তু আমি আপনাদের সবাইকে একবার চিটাগাং নিয়ে যাব। কক্সবাজার দেখায়ে নিয়ে আসব। নিজের মায়ের কোনো সেবা তো করতে পারি নাই। মাতৃঋণ শোধ হয় নাই। দেখি আপনাকে দিয়ে যদি…।
বোকাসোকা বাবা মাদের ছেলেমেয়েরা বিছু হয়। আর ছেলেমেয়ে বলতে যদি একটাই হয় তাহলে সেটা হয় চিকন বিছু। বাইরের চেহারা থাকবে সরলটাইপ, বুদ্ধি থাকবে চিকন। মসলিনের সূতা চোখে দেখা যায় না। এমন চিকন। ইকবাল সাহেবের মেয়ে রুনু যে চিকন বুদ্ধির মসলিন এটা ধরা পড়ল চতুর্থ দিনে। সে কলেজে যাবে অ্যাডমিট কার্ড আনতে। মনজু সঙ্গে গেছে রিকশা ঠিক করে দিতে। রুনু বলল, আপনাকে আসতে হবে না। আমি রিকশা ঠিক করতে পারি।