- বইয়ের নামঃ এই শুভ্র! এই
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ঘুম ভাঙার পর ঘড়ি
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ঘুম ভাঙার পর ঘড়ি দেখতে চায়। কখন ঘুম ভাঙল এটা জানা যেন খুবই জরুরি। যারা কাজের মানুষ তারা যেমন ঘড়ি দেখে অকাজের মানুষরাও দেখে।
শুভ্র সম্ভবত এই দুই দলের কোনোটাতেই পড়ে না। তার ঘরে কোনো দেয়ালঘড়ি নেই। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় হাতঘড়িটাও সে বালিশের নিচে রাখে। না। অথচ ঘুম ভাঙার পর তারই সবচে বেশি সময় জানতে ইচ্ছা করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘড়ি না দেখে সময় আন্দাজ করার নানান কায়দাকানুন তার আছে। জানালা দিয়ে আসা রোদ যদি খাটের বা দিকের পায়াতে ঝলমল করতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখনো আটটা বাজে নি। আটটার পর খাটের বা পায়ে কোনো রোদ থাকে না।
সিলিং-এর মাঝামাঝি জায়গায় চারকোণা (ম্যাচ বাক্সের সাইজ) রোদ থাকে সকাল সাতটা পর্যন্ত। সিলিং-এ রোদ না থাকলে বুঝতে হবে সাতটার বেশি বাজে। চারকোণা এই রোদ কোন ফাঁক দিয়ে আসে শুভ্ৰ এখনো বের করতে পারে নি। এই ব্যবস্থা অবশ্যি গরমকালের। শীতের দিনে সকাল নটা পর্যন্ত ঘরে কোনো রোদই আসে না।
শুভ্রর বয়স যখন দশ এগারো তখন সময় জানার তার খুব একটা ভালো ব্যবস্থা ছিল। ঠিক সাতটায় তার জানালার পাশে একটা কাক এসে বসত। ঘাড় বঁকিয়ে রাগী রাগী চোখে শুভ্রর দিকে তাকাত। কা কা করে দুবার ডেকেই ঝিম মেরে যেত।
কাকটার সঙ্গে শুভ্রর এক সময় বন্ধুত্বের মতো হয়ে যায়। সে দিব্যি ঘরে চুকত। নাশতা খাবার সময় সে শুভ্রর হাত থেকে পাউরুটি খেত। শুভ্ৰ কাকটার একটা নামও দিয়েছিল— কিংকর।
শুভ্রর বাবা মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, কিংকর আবার কেমন নাম? তুই এর নাম দে Old faithful. কাটায় কাটায় সাতটার সময় সে যখন আসে তার এই নামই হওয়া উচিত।
মোতাহার হোসেন সাহেব কাকটার সময়ানুবর্তিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিংকর সত্যি সত্যি সকাল সাতটায় আসে কি-না তা দেখার জন্যে তিনি অনেকবার সাতটা বাজার আগে ঘড়ি হাতে ছেলের ঘরে বসেছেন। এবং প্রতিবারই মুগ্ধ গলায় বলেছেন— ভেরি ইন্টারেস্টিং, কাকটা তো ঘড়ি দেখেই আসে! কোনো একজন পক্ষী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে
হবে।
শুভ্রর মা কাকের ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেন নি। অলুক্ষ্মণে পাখি রোজ ছেলের ঘরে এসে ঢুকবে কেন? কোনো কাক কখনোই মানুয্যের কাছে আসে না। এটা কাক না, অন্য কিছু।
মোতাহার হোসেন বললেন, অন্য কিছু মানে কী?
কাকের বেশ ধরে অন্য কিছু আসছে। খারাপ জিনিস। কাকটা আসা শুরু করার পর থেকে শুভ্ৰ কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে লক্ষ করছ না?
মোতাহার হোসেন বললেন, আমি তো কিছু লক্ষ করছি না।
কী আশ্চর্য! শুভ্রর চোখের নিচে কালি পড়েছে, তুমি দেখছ না? এই বদকাক যেন না আসে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
শেষপর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি। কাকটা প্ৰায় এক বৎসর রোজ এসে হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করল।
এখন শুভ্রর বয়স চব্বিশ। প্রায় বার-তের বছর আগের ব্যাপার, অথচ শুভ্রর মনে হয়- তার বয়স বাড়ে নি। সময় আটকে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিংকর এসে জানালায় বসে গম্ভীর গলায় দুবার কা কা করেই চুপ করে যাবে। এই কাকটা মাত্র দুবার ডাকে, তারপর আর ডাকে না।
শুভ্রর ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। সে বিছানায় শুয়ে আছে। সময় কত হয়েছে সে ধরতে পারছে না। আষাঢ় মাস। সূর্য মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। খাটের নকশা করা পায়াতে আলো এসে পড়ে নি। সময়টা জানার জন্যে সে নিজের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করছে। যেন তাকে আজ কোনো কাজে যেতে হবে। খুবই জরুরি কোনো কাজ। অথচ তার কোনো কােজ নেই। শুভ্র দিনের প্রথম চায়ের জন্যে অপেক্ষা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকিনা নামের এই বাড়ির কাজের মেয়েটা চা নিয়ে আসবে। শুভ্রর ঘুম ভাঙলেই এই মেয়ে কীভাবে যেন টের পায়। চায়ের কাপ হাতে জানালার বাইরে এসে ক্ষীণ গলায় বলে— ভাইজান, চা এনেছি। শুভ্ৰ যে জেগেছে মেয়েটা টের পায় কী করে? কোনো একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে। সেই কোনো একদিন যে আজই হতে হবে তা-না।
ভাইজান, চা এনেছি।
শুভ্ৰ কিছু বলল না। বিছানায় উঠে বসল। সকিনা ঘরে ঢুকল। শুভ্রকে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতে হলো না। তার ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে।
চায়ের কাপ হাতে দিয়েই সকিনা চলে যায় না, কাপে চুমুক না দেয়া পর্যন্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্রর ধারণা চায়ের কাপে চুমুক দিতে সে যদি পনের মিনিট দেরি করে তাহলে এই মেয়েটা পনের মিনিট মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোনো একদিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে দশ পনেরো মিনিট বসে থাকবে। দেখার জন্যে মেয়েটা সত্যি দাঁড়িয়ে থাকে কি-না। আজই যে করতে হবে তার কোনো মানে নেই। Some other day.
শুভ্ৰ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিছানা থেকে নামল। এখন তার কাজ কম্পিউটার চালু করে কয়েক লাইন লেখা। এই অভ্যাস আগে ছিল না, নতুন হয়েছে। মানুষ যে-কোনো অভ্যাসে দ্রুত অভ্যস্থ হয়ে যায়।
শুভ্র কী-বোর্ডে অতি দ্রুত হাত চালাচ্ছে। স্ক্রিনে লেখা উঠছে, এই সঙ্গে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে। সাউন্ডবক্স থেকে পিয়ানো বাজানোর মতো শব্দ হচ্ছে। এটা শুভ্রর নতুন কর্মকাণ্ড। সে একটা সফটওয়্যার তৈরি করেছে। প্রতিটি অক্ষরের জন্যে পিয়ানোর একটা রিডের শব্দ। ব্যাপারটা এরকম যেন শব্দ শুনে সে বলে দিতে পারে কী লেখা হচ্ছে।