সোহাগী গ্রামে স্কুল হবে খুব ভাল কথা। বিদ্যাশিক্ষায় দোষ কিছু নাই। আমাদের নবী করিম বিদ্যাশিক্ষার কথা বলেছেন। তবে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে টিপু সুলতান নাটক করতে হবে এটা কেমন কথা? সেই নাটকের জন্যে পাড়া থেকে মেয়ে নিয়ে আসতে হবে এটাই বা কেমন কথা। মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে এর সঙ্গে কি নাটকের মেয়ের কোনো যোগ নাই? ইসকান্দর আলি তার এই জাতীয় সন্দেহের কথা কাউকে বলবেন কিনা এখনো বুঝতে পারছেন না। মিটিং করে সবাইকে বলার দরকার নাই। এক দুইজনকে ঠিকঠাক মতো বলতে পারলেই কথা চলা শুরু করবে। কথা শুরু করাটাই কঠিন। একবার শুরু করলে কথা চলতে থাকে
গ্রামের মানুষ তাঁর কথায় কতটা গুরুত্ব দেবে তাও তিনি ধরতে পারছেন না। বিদেশি মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। তিনি বিদেশি মানুষ। আর দশটা মানুষের সঙ্গে যে মিশ খায় না, তাকেও কেউ পছন্দ করে না। তিনি আর দশটা মানুষের সঙ্গে মিশ খান না। যারা সারাক্ষণ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে তাদের মানুষ ভয়ের চোখে দেখে। তিনি তাই করেন। দিনের পর দিন রোজা করেন। রোজার একটা সোয়াব তো আছেই, তাছাড়াও রোজার অনেক সুবিধা আছে- সারাদিন খাওয়াখাদ্যের কোনো ঝামেলা নাই। সন্ধ্যাবেলা ইফতারের সময় কোনো-এক বাড়িতে উপস্থিত হন। যার বাড়িতে যান সে খুবই আনন্দের সঙ্গে ইফতার ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে শেষরাতের খাবার একটা বাটিতে করে সেখান থেকেই নিয়ে যান। কবে কোন বাড়িতে খাবেন এটা আগে থেকে বলেন না। এতে একধরনের রহস্য তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ রহস্য পছন্দ করে।
দিনের পর দিন রোজা রাখার একটা উপকারিতা তিনি ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছেন। তার ব্যাপারে এই কথাটা চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। এখন অনেক দূর থেকে তাঁর কাছে লোকজন পানিপড়া নিতে আসে। তিনি ফিরিয়ে দেন। মুখে বলেন, এখনো সময় হয় নাই। সময় হোক পানিপড়া দিব।
এতেও খানিকটা রহস্য তৈরি হচ্ছে। তার মতো মানুষের জন্যে যত বেশি রহস্য তৈরি হয় তত ভালো। তিনি আরেকটা কাজ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে করেন– কোরান পাক মুখস্থ করা। ছোটবেলায় হাফেজিয়া মাদ্রাসায় চার বছর ছিলেন। তাতে লাভ হয় নি। তার সঙ্গের সবাই হাফেজ হয়ে গেছে, তিনি পারেন নাই। কোরানে হাফেজ সবাই হয় না। যার উপর আল্লাহপাকের খাস দয়া আছে সেই হতে পারে। তার উপর আল্লাহপাকের যে খাস দয়া নাই তা তিনি বুঝতে পারেন। তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যে-কোনো একদিন সফল হয়ে যাবেন। সেটা আজ রাতেও হতে পারে, কালও হতে পারে। আবার আরো একবছর লাগতে পারে।
মওলানা ইসকান্দর আলি ঝড়ের পর হাঁটতে বের হয়েছেন। আজ তার পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। মনের উপর চাপ গিয়েছে বলেই বোধ হয় এই তৃষ্ণা। বুক মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। কোন বাড়িতে ইফতার করবেন তিনি। এখনো ঠিক করেন নি। হুট করে কোনো বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ইফতারের কথা বললে তাদের বিপদেই ফেলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত খারাপ ইফতার, কোনো বাড়িতে করেন নি। কাটা পেঁপে, শশা, দুধ-চিড়া, একটা ডিম সেদ্ধ, একটা কলা, তেল মরিচ দিয়ে মাখানো চাল ভাজা। নাই নাই করেও অনেক কিছু হয়ে যায়।
ঝড় এই গ্রামের মোটামুটি ভালোই ক্ষতি করেছে। ঘরবাড়ি না ভাঙলেও বেশকিছু গাছপালা ভেঙেছে। সুলেমানের নতুন বানানো টিনের ঘরের সব টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে। অথচ সুলেমানের পাশেই বিষ্ণুর কাঁচা খড়ের বাড়ির কিছুই হয় নি। আল্লাহপাকের কর্মকাণ্ড বোঝা সাধারণ মানুষের কর্ম না।
মওলানা ইসকান্দর আলি একবার ভাবলেন, ইফতারের জন্যে বিষ্ণুর বাড়িতে উপস্থিত হলে কেমন হয়। অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না এমন তো কোনো কথা হাদিস কোরানে নাই। তাছাড়া বিষ্ণু লোক অত্যন্ত ভালো। সে কখনো মিথ্যাকথা বলে না, এবং সুযোগ পেলেই মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে। বিষ্ণু তার জন্যে একটা শীতল পাটি বুনে দিয়েছে। একটা তালের পাখা বানিয়ে দিয়েছে।
নবী করিমের একটা হাদিস আছে। এক সাহাবা নবী (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম কী? নবী উত্তরে বললেন, ইসলাম হল সত্য ভাষণ এবং পরোপকার।
এই বিবেচনায় বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বলা যায়, ও বিষ্ণু আইজ তোমার ঘরে ইফতারি করব। বিষ্ণু ছোটাছুটি করে ভাল যোগাড়ই করবে। আর যোগাড় করতে না পারলেও কিছু করার নেই। রিজিক উপর থেকে আসে। মানুষভাবে তার খাওয়া খাদ্য সে যোগাড় করে। আসল ঘটনা ভিন্ন। পিপীলিকা জানে না তার খাদ্য কে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে পিপীলিকা যায় হঠাৎ দেখে দুইটা চিনির দানা। পিপীলিকা খুশি। সে জানে না এই চিনির দানা তার চলার পথে কে ফেলে গেল। সে মহানন্দে চিনির দানা ঘরে নিয়ে যায়। পিপীলিকা যেমন চিন্তা করে না, মানুষও চিন্তা করে না। অথচ মানুষকে চিন্তা করার বুদ্ধি আল্লাহপাক দিয়েছেন।
ইস্কান্দার আলি বিষ্ণুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন- বিষ্ণুকে ডাকবেন কী ডাকবেন না মনস্থির করতে পারছেন না। ইফতার ওয়াক্তের বেশি দেরি নাই। মনস্থির করা দরকার।
কে, মওলানা সাহেব না?
ইস্কান্দার আলি চমকে তাকালেন। তার পেছনে সুলতান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সুলতান সাহেবের সঙ্গে তাঁর আগে পরিচয় হয় নাই। এই প্রথম দেখা। কেউ না বলে দিলেও তাঁর চিনতে অসুবিধা হল না। শহরবাসী মানুষের শরীরে শহরের চিকন লেবাস চলে আসে। এই লেবাস চোখে দেখা যায় না। তবে লেবাসের ফলে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। একজন শহরবাসী মানুষ যদি খালি গায়ে হাঁটু উঁচু লুঙ্গি পরে গ্রামের কোনো ক্ষেতের আলের উপর বসে থাকে তখনও তাকে চেনা যায়। শিক্ষার লেবাসও আছে। এই লেবাসও চোখে দেখা যায় না। একই পোষাক পরিয়ে একজন শিক্ষিত এবং একজন মূর্খকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখলেও চেনা যায়– কে শিক্ষিত কে মূর্খ।