মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ তৈরির প্রস্তাব এক জুম্মা বারে করা হল। মওলানা ইসকান্দর আলি কঠিন গলায় বললেন, প্রস্তাব যিনি করেছেন তিনি তওবা করেন। আল্লাহর ঘর মেরামত করা যায়, ভাঙা যায় না। উনার ঘর উনি যদি ভাঙতে চান তিনি নিজে ভাঙবেন।
সেই ঘটনাই ঘটেছে। জয়ুন খাঁ মসজিদ ধুপ করে ভেঙে ঢিবির মতো হয়ে আছে। পুরো ঘটনাটা ঘটেছে মওলানা ইসকান্দর আলির সামনে। মওলানা সাহেব এই বিভীষিকা দূর করতে পারছেন না। তিনি আতঙ্কে কাঁপছেন। মসজিদ থেকে বের হতে আর দুটা মিনিট দেরি হলে তিনি স্কুপের নিচে চাপা পড়তেন। ঘটনা কিভাবে ঘটল মওলানা তার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা দিলেন এই ভাবে :
আছরের নামাজ শেষ করলাম আমি একা। দিন খারাপ দেখে কোনো মুসুল্লি আসে নাই। যাই হোক, কী আর করা। আমি তো দড়ি দিয়ে বেঁধে মুসুল্লি আনতে পারব না। ঐটা বাদ থাকুক। যে কথা বলছিলাম আছরের নামাজ শেষ করে তসবি নিয়ে বসেছি। আপনারা হয়তো জানেন আছর থেকে মাগরের পর্যন্ত সময়টা খুব জটিল। কেয়ামত হবে আছর থেকে মাগরেবের মাঝখানের সময়ে।
আমি একমনে তসবি পড়তেছি। শুধু হয়েছে ঝড়। আমি ভাবলাম হোক না ঝড়। আমি বসে আছি আল্লাহর ঘরে। আমার আবার ভয় কী? আমি চোখ বন্ধ করে তসবি পাঠে মন দিয়েছি। তখন কলবের ভিতরে কে। যেন বলল- ইসকান্দর বাইরে যাও, সময় খারাপ। আমি বাইর হইলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ধুপ।
মওলানা ইসকান্দর আলি যেরকম রোমহর্ষক বর্ণনা দিতে চেয়েছিলেন তেমন দিতে পারলেন না। ঘটনা বর্ণনার উত্তেজনার কারণে ধুপ শব্দটার অদ্ভুত উচ্চারণ করলেন। অদ্ভুত উচ্চারণের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি যুক্ত হওয়ায় এবং হাতের বেতের ছড়িটাও ধুপ করে পড়ে যাওয়ায় কিছু হাস্যরস তৈরি হল– কয়েকজন হেসে ফেলল।
মওলানা বললেন, হাসেন কে? আল্লাহ পাকের ঘর ভেঙে গিযেছে এর মধ্যে হাসির কিছু আছে? হাসি বন্ধ করে এই ঘটনা কেন ঘটল বিবেচনা করেন। এই সোহাগী গ্রামে কী গজব আসতেছে এইটা একটু ভাবেন। আল্লাহপাক এই অঞ্চলে তার ঘর চায় না। কেন চায় না?
ইসকান্দর আলি বক্তব্য শেষ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। শ্রোতাদের ভেতর তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এরা কি নতুন মসজিদ তৈরি করবে? নতুন মসজিদ না হলে তার চাকরির কী হবে? সে বিদেশি মানুষ। মসজিদের ইমামতি বাবদ তাকে মাসে পাঁচশ টাকা দেয়া হয়। গ্রামের মসজিদের ইমামতির টাকা কখনোই ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার, এটা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল। বিয়ে, আকিকা, মিলাদে টাকাপয়সা খারাপ আসছিল না। তবে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের যে-ব্যাপারটা আছে তা হচ্ছিল না। গ্রাম্য বিচার বা সালিসিতে তাকে কখনো কেউ ডাকে না। গ্রামে একটা স্কুল হবে। সেই বিষয়ে প্রায়ই সভা-সমিতি হয়, সেখানেও তাঁর ডাক পড়ে না। ডাক পড়লে স্কুলের চেয়ে মাদ্রাসার প্রয়োজন যে বেশি তা তিনি গুছিয়ে বলতে পারতেন। যে শিক্ষায় আল্লাহকে পাওয়া যায় সেই শিক্ষাই আসল শিক্ষা। স্কুল কলেজের শিক্ষা ইহকালের জন্যে। মাদ্রসার শিক্ষা ইহকাল-পরকাল দুই জাহানের জন্যে। সোহাগীতে একটা ঈদগা দরকার। যে ঈদগায় আশেপাশের মানুষও নামাজ পড়তে আসবে। সেই বিষয়েও কারো কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ঈদগা বানাতে তো আর দালান কোঠা তুলতে হয় না। ইমাম সাহেবের খোবা পড়ার একটা জায়গা হলেই হয়। তিন শ ইট দুই বস্তা বালি এক বস্তা সিমেন্ট।
মওলানা ইসকান্দর আলি খুবই মন খারাপ লাগছে। মসজিদ ভাঙার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটার পরও মানুষ কী স্বাভাবিক আছে! যে এটা কোন ব্যাপার না।
মওলানা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আপনাদের কথা জানি না। আমি অতি ভয়ে আছি। আমাদের উপর বিরাট গজব আসতেছে।
গনি মিয়া বললেন, গজবের কথা আসতেছে কেন? বহুদিনের পুরানা মসজিদ। কোনোদিন মেরামতি হয় নাই। বাতাসের ধাক্কা লাগছে। ভাইঙ্গা পড়ছে। এতদিন যে টিকেছে এটাই যথেষ্ট।
ইসকান্দার আলি বিরক্ত-চোখে গনি মিয়ার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। গনি মিয়া এই অঞ্চলের ক্ষমতাবান মানুষদের একজন। পরপর তিনবার চেয়ারম্যান ইলেকশন করেছেন। পাশ করতে পারেন নাই। সেটা কোন কথা না। তিনবার ইলেকশন করার ক্ষমতা কয়জনের থাকে? জমি-জিরাত ছাড়াও নেত্রকোনা শহরে তাঁর রাইসমিল আছে। একটা করাত কল কেনার চিন্তাভাবনা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষের মুখের উপর কথা বলা যায় না। সত্য কথাও বলা যায় না। দিনকাল পাল্টে গেছে, এখন আর মানুষ আগের মতো নাই। মওলানা ধরনের মানুষের দিকে। এখন আর আগের মতো ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে কেউ তাকায় না। মওলানাও যে বিবেচনায় রাখার মতো একজন, কেউ তাও বোধ হয় মনে করে না। ছট্ফট্ ভাবে।
সোহাগী গ্রামটা অনেক ভেতরের দিকে হলেও থাকার জন্যে ভালো। গ্রামের মানুষ হতদরিদ্র না। সবারই অল্প-বিস্তর হলেও জমি-জিরাত আছে। এরা খাটাখাটনি করে। আমোদ ফুর্তি হৈচেও করে। ক্লাবঘরের মতো আছে। ক্লাবঘরে পত্রিকা আসে। একটা লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিতে দুই আলমারি বই। ব্যাটারিতে চলে এমন টিভি আছে। যেদিন যেদিন নাটক চলে, ভাড়া করে ব্যাটারি আনা হয়।
মওলানা ইসকান্দর আলি এদের সাথে যোগ দিতে পারেন না, তিনি মওলানা মানুষ। টিভির সামনে বসে প্রেম-ভালবাসার নাটক দেখবেন এটা কেমন কথা? ইচ্ছা থাকলেও গ্রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হয়। আমোদ ফুর্তির সবটাই আসলে শয়তানি কর্মকাণ্ড। এইসব কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়ানোও ঠিক না। আবার এদের কাছ থেকে খুব দূরে থাকাও ভুল। গ্রামের মানুষদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। দুধকে দই বানাতে হলে দইয়ের বীজ হয়ে দুধের সঙ্গে মিশতে হবে। দই-এর বীজ দশ হাত দূরে রেখে দিলে দুধ দুধই থাকে দই হয় না।