সালভাদর ডালি লিখেছেন- আমি শিশুদের পছন্দ করি না। একজন শিল্পী শিশুদের পছন্দ করেন না তা-কি হয়? শিল্পীর অনুসন্ধান হচ্ছে। সৌন্দর্য এবং সত্যের অনুসন্ধান। শিশুরা একই সঙ্গে সত্য ও সুন্দর।
চোখে ঘুম নিয়ে জটিল ধরনের চিন্তা করা যায় না। তখন ঘুম আরো বেশি পায়। সুলতান সাহেব বই বুকের উপর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন- শো শো শব্দ হচ্ছে। সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ। সেই সঙ্গে দুলুনি। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন তাঁর মেয়ে রানু তাকে ডাকছে- বাবা উঠ, বাবা উঠ। ঝড় হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়।
স্বপ্নের মধ্যেই তিনি ঝড় দেখলেন। স্বপ্নে ভয়াবহ বিপর্যয় দৃশ্যগুলোতেও আনন্দ মেশানো থাকে। তিনি স্বপ্নে ঝড় দেখছেন। সেই দৃশ্য তাঁর কাছে খুবই সুন্দর লাগছে। তিনি দেখছেন খড়কুটোর মতো ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে তার মনে হচ্ছে পাখির পালকের মতো। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন রানুকে দেখা যাচ্ছে। ঝড় তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে গেলেও রানুকে উড়িয়ে নিচ্ছে না। রানুর লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। এবং সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে ডাকছে- বাবা বাবা।
সুলতান সাহেবের ঘুম ভাঙ্গল। তিনি দেখলেন এই বিকেলেও ঘর অন্ধকার। এবং সত্যি সত্যি ঝড় হচ্ছে। বাড়ির জানালায় খট খট শব্দ হচ্ছে। ঘর ভর্তি ধুলোভরা বাতাস। সুলতান সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন। রানু আনন্দিত গলায় বলল, বাবা ঝড় হচ্ছে।
আশ্বিন মাসের ঝড়ে এত আনন্দিত হওয়া ঠিক না। আশ্বিনা ঝড় প্রবল হয়ে থাকে। বাড়ি-ঘর তুলে নিয়ে যায়। ঝড় তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে।
রানু বলল, বাবা আমি ঝড় দেখতে বাগানে যাব।
সুলতান সাহেব বললেন, পাগলামী করবি না। ঝড় দেখার জন্যে বাগানে যেতে হয় না। ঘরের ভেতর থেকে ঝড় দেখা যায়।
আমার বাগানে যেতে ইচ্ছে করছে বাবা।
ডাল ভেঙ্গে মাথার উপর পড়বে।
রানু শাড়ির আঁচল কোমরে জড়াতে জড়াতে বলল, পড়ক। সুলতান সাহেবকে রানু আর কোন কথা বলার সুযোগ দিল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নেমে গেল। বাগানের গাছপালা যে হারে দুলছে-ডাল ভেঙ্গে পড়বে এটা প্রায় নিশ্চিত। মেয়েকে যুক্তি দিয়ে এখন ফেরানো যাবে না। কিছু মুহূর্ত আসে যখন মানুষ কোন যুক্তি মানে না। সুলতান সাহেব দেখলেন রানু প্রায় ঝড়ের মতোই এক গাছের নিচ থেকে আরেক গাছের নিচে যাচ্ছে। সে মনে হয় নিজের মনে চেঁচাচ্ছেও। ঝড়ের কারণে তার চিৎকার শোনা যাচ্ছে না।
সুলতান সাহেবের মনে হলো রানুকে একা একা বাগানে ছোটাছুটি করতে দেয়া ঠিক না। তার উচিত মেয়ের কাছে যাওয়া। সেটাও করা যাবে না রানুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে একা একা ছোটাছুটি করতে তার ভাল লাগছে। ঝড়ের মাঝখানে সে তার নিজের একটা জগত তৈরি করে ফেলেছে। এই জগতে সুলতান সাহেবের কোন মূল্য নেই। মেয়ের আনন্দে তিনি ভাগ বসাতে পারছেন না। ডাল ভেঙ্গে মেয়ের মাথায় পড়বে এই দুঃশ্চিন্তাটাও তিনি দূর করতে পারছেন না। যা ঘটার তা ঘটবেই ফেটালিস্টদের মতো এই চিন্তাও করতে পারছেন না। জটিল কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। আচ্ছা সালভেদর ডালি কি কোন ঝড়ের ছবি এঁকেছেন? প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে সেরকম কোন ছবি? না আঁকেন নি। মাইকেল অ্যাঞ্জালো আঁকেন নি, গঁগা আঁকেন নি। আধুনিক কালের মন্টে আঁকেন নি, পিকাসো আঁকেন নি। কেন আঁকেন নি? তাঁরা কি ঝড় দেখেন নি। তাঁরা সবাই কি ভীতু প্রকৃতির ছিলেন? ঝড়ের সময় তাঁরা দরজা বন্ধ করে ছিলেন?
.
সোহাগী গ্রামে ভয়ংকর একটা ব্যাপার হয়েছে। বিকাল পাঁচটা দশম মিনিটে গ্রামের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। ভাদ্রমাসের শেষে আশ্বিনের শুরুতে এরকম ঝড় হয়। এই ঝড়কে বলে আশ্বিনা ঝড়। কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে পড়ে। টিনের চালা উড়ে যায়। গ্রামের মানুষ এ ধরনের ঝড়ের সঙ্গে পরিচিত। তাদের কাছে একটা ভয়ংকর কিছু না।
ভয়ংকর ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে ঝড়ের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ধুপ করে একটা শব্দ হল। চাপা আওয়াজ কিন্তু ঝড় ছাপিয়েও সেই আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজটার মধ্যেই অশুভ কিছু ছিল। অশুভ ব্যাপারটা জানা গেল ঝড় থামার পর। সোহাগী গ্রামের পাঁচশ বছরের পুরনো এক মসজিদ ভেঙে পড়ে গেল। মসজিদের নাম জমুন খাঁ মসজিদ। অনেক দিন ধরেই মসজিদ ভেঙে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দেয়াল এবং ছাদ ফেটে গিয়েছিল। বৃষ্টির সময় ফাটা ছাদ দিয়ে পানি পড়ত। ভাঙা দেয়ালে সাপ আশ্রয় নিয়েছিল। একবার জুমা নামাজের খোৎবা পাঠের সময় সাপ বের হয়ে পড়েছিল। মসজিদের ইমাম মওলানা ইসকান্দার আলি সাপটা প্রথমে দেখেন এবং খোত্বা পাঠ বন্ধ করে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে ওঠেন। সাপটা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে চলে যায়। জুমার নামাজের শেষে মসজিদে যে সাপ বাস করে তাকে মারা যায় কি যায় না তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আল্লাহর ঘরে যে আশ্রয় নিয়েছে তাকে মারা কি ঠিক? সে তো কারো কোনো ক্ষতি করে নাই।
মওলানা ইসকান্দর আলি বয়স পঞ্চাশ। রোগা শরীর। অতিরিক্ত লম্বা বলে খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন। হাতে ছড়ি নিয়ে হাঁটার বয়স তার হয় নি। তারপরও তার হাতে বিচিত্র একটা বেতের ছড়ি সবসময় থাকে। হাঁটার সময় ছড়িটা তিনি হাত বদল করতে থাকেন। এই বাঁ হাতে এই ডান হাতে। মোটামুটি দেখার মতই দৃশ্য। মওলানা ইস্কান্দার আলি নিজের চারদিকে রহস্য তৈরি করে রাখতে পছন্দ করেন। মওলানা সাহেব শুরু থেকেই মসজিদেই ঘুমাতেন। কারণ আল্লাহর ঘর কখনোই পুরোপুরি খালি রাখা ঠিক না। তাছাড়া ইবাদত ছাড়াও মসজিদে বসে থাকার মধ্যে সোয়াব আছে। সাপ বের হবার পরে অবশ্যি ইসকান্দার আলি মসজিদে ঘুমানো ছেড়ে দিলেন।