কেন সম্ভব না। এই লোক কে? তার কেউ না। মৃত মানুষটাকে নিয়ে তার গ্রামে উপস্থিত হবার কোন মানে হয় না। সে নাটকের মেয়ে। যাচ্ছে। টিপুসুলতান নাটক করতে। নাটকের প্রধান উদ্যোক্তা মারা গেছে। নাটক অবশ্যই হবে না। সে সোহাগী গ্রামের উপস্থিত হয়ে কী করবে? তার টাকা পাওয়ার কথা, সে পেয়ে গেছে। এই টাকায় মার ঠ্যাং কাটা হচ্ছে।
চিত্রা নদীর পানিতে প্লাস্টিকের জগভর্তি করে মাহফুজের মাথায় ঢালছে। নদীর পানি গরম। রোদে পানি তেতে উঠেছে। গরম পানি মাথায় ঢাললে কি জ্বর কমে?
ইনজিনের নৌকা ভটভট করে চলছে। ছোট ছেলেটা আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। যে বুড়ো মাঝি হাল ধরে ছিল- সেও একবার উঁকি দিল। চিত্রা বলল- আপনি কি ইনাকে চিনেন?
বুড়ো মাঝি বলল, জ্বি না।
যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গাটা চেনেন তো? গ্রামের নাম সোহাগী।
জ্বে চিনি। নিমঘাটা।
নিমঘাটা না, সোহাগী।
নিমঘাটায় নাও থামব। হাঁটা পথে সোহাগী যাইবেন।
কতক্ষণ হাঁটতে হবে?
ক্যামনে কই?
ক্যামনে কই মানে? সোহাগী কখনো যান নি?
জ্বে না। নিমঘাটা গেছি। বুধবারে নিমঘাটায় হাট বসে। বড় হাট।
নিমঘাটায় ডাক্তার আছে?
জানি না।
নিমঘাটায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
ফুল ইসপিডে দিলে দেড় ঘণ্টা। যেমনে যাইতেছি– দুই আড়াই ঘণ্টা লাগব।
ফুল স্পিড দিন।
দেওন যাইব না। ইনজিন ডিসটাব আছে।
যখন সমস্যা হয় একের পর এক সমস্যা হতে থাকে। নৌকা একটা নেয়া হয়েছে ইনজিন ডিসটাব। হয়ত দেখা যাবে কিছুক্ষণ পর ইনজিন পুরোপুরি থেমে যাবে।
রোদ মরে আসছে। আকাশে চিল উড়ছে। বাচ্চা ছেলেটা বলল তুফান হইব। ছেলেটার মুখ হাসি-হাসি। যেন তুফান হওয়া ইনজিন থেকে তেল ছিটকে যাওয়ার মতোই কোন আনন্দময় ঘটনা। পুরোপুরি নৌকা ডুবলে তার আনন্দ মনে হয় আরো বেশি হবে।
চিত্রা বলল, তুফান হবে কেন? আকাশে তো মেঘ নেই।
এট্টু পরেই দেখবেন আসমান আন্ধাইর।
ঝড়ের সময় নৌকা কি নদীর উপর থাকবে? না কুলে ভিড়বে?
বুড়ো মাঝি বলল, অবস্থা বুইঝা ব্যবস্থা। যেমন অসুখ তেমন দাওয়াই।
নৌকাডুবি অসুখের দাওয়াই কী হবে? চিত্রা সাঁতার জানে না। সাঁতার না জানা অসুখের কোন দাওয়াই থাকার কথা না।
আকাশের চিল নিচে নেমে আসছে। রোদের তেজ দ্রুত কমছে। তবে আকাশের কোথাও কোন মেঘ নেই। মেঘ ছাড়া রোদের তেজ কমে যাচ্ছে। কী ভাবে সেও এক রহস্য।
মানুষটা এতক্ষণ চোখ মেলে ছিল। পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এখন চোখ বন্ধ। জ্বর বোধ হয় একটু কমেছে। এখন ঘুমুচ্ছে। ক্রমাগত পানি ঢালার কারণে কপালে হাত দিয়ে জ্বর টের পাওয়া যাচ্ছে না। চিত্রা ডাকল– এই যে শুনুন। আপনি কি ঘুমুচ্ছেন?
মানুষটা জবাব দিল না। তবে বড় করে নিশ্বাস ফেলল।
আপনার শরীরটা কি এখন একটু ভাল লাগছে?
এই প্রশ্নেরও জবাব নেই। চিত্রা বুঝতে পারছে না সে পানি ঢালা বন্ধ করবে না চালিয়ে যাবে।
নৌকার ছেলেটা আঙুল উঁচিয়ে বলল- এই দেখেন মেঘ।
চিত্রা মেঘ দেখল। কালো একখণ্ড মেঘ দেখা যাচ্ছে। ভীতিজনক কিছু না। কিংবা কে জানে হয়ত এই মেঘই ভয়াবহ। সাপুড় যেন সাপের হাঁচি চেনে– যারা নৌকা চালায় তারা চেনে মেঘের হাঁচি।
চিত্রা বলল, ঝড় কখন হবে?
দিরং আছে।
ছেলেটা কথাটা বলল দুঃখিত গলায়। ঝড় আসতে দেরি আছে এই দুঃখে সে মনে হয় কাতর।
চিত্রা বলল, ঝড় আসতে আসতে কি আমরা নিমঘাটায় পৌঁছব?
জানি না।
বিপদ যখন আসে একটার পর একটা আসে। বিপদরা পাঁচ ভাইবোন। এদের মধ্যে খুব মিল। এই ভাইবোনরা কখনো একা কারো কাছে যায় না। প্রথম একজন যায়, তারপর তার অন্য ভাইবোনরা উপস্থিত হয়। ঝড় যে হবে তা নিশ্চিত। এবং ঝড়ে অবশ্যই নৌকা ডুবে যাবে।
ইনজিনের ভটভট শব্দ হচ্ছে না। চিত্রা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বুড়ো মাঝি বলল, ইনজিলে ডিসটাব আছে। ঠিক করতাছি। চিন্তার কিছু নাই।
ইনজিন ঠিক করতে জানেন?
ইনজিন গরম হইছে। ঠাণ্ডা হইলে আপছে ঠিক হইব।
মাঝি নৌকা তীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কালো মেঘের টুকরাটা দ্রুত বড় হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটা মরে যায়নি তো?
না, মরে নি। এইতো বুক উঠানামা করছে। চিত্রা মাথায় পানি দেয়া বন্ধ করে ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
কালো মেঘ ঘন হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন মেঘের নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে আসছে। তীব্র অসহনীয় গরমটা আর নেই। বরং শীত শীত লাগছে। ঝড়ের আগে ঠাণ্ডা বাতাস বয় না-কী?
চিত্রা শোন!
চিত্রা মেঘ দেখছিল। সে চমকে তাকাল। মানুষটা দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করেছে। চিত্রা বলল, কিছু বলবেন?
মানুষটা হড়বড় করে বলল, সুলতান সাহেব আমাদের প্রধান অতিথি। উনি অনেক বড় মানুষ। তাকে বললেই তিনি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কি ব্যবস্থা?
পড়াশোনা, চাকরি।
চিত্রা তাকিয়ে আছে। মানুষটা ঘোরের মধ্যে কথা বলছে। তার সঙ্গে তর্ক বিতর্কে যাওয়া ঠিক না। চিত্রা বলল, আপনি শুয়ে পড়ুন।
মাহফুজ বলল, জ্বি আচ্ছা। বলেই আগের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝড় এসে পড়ল।
দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস
০২.
দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস সুলতান সাহেবের নেই। সেই সুযোগও অবশ্যি নেই। লাঞ্চের পর তিনি গা এলিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন। শুয়ে থাকতে থাকতে যেন ঘুম না এসে যায় তারজন্যে হাতে ইন্টাররেস্টিং কোন বই থাকে। ঘুম যখন চোখ জড়িয়ে আসে তখন তিনি বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করেন। আজ ঘুম তাড়াবার জন্যে তাঁর হাতে আছে সালভাদর ডালির বিখ্যাত ডায়েরী। ডায়েরীর কথাগুলো এই বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী সত্যি সত্যি লিখেছেন না নিজেকে বিশিষ্ট করার জন্যে লিখেছেন সুলতান সাহেব ঘুম ঘুম চোখে তা ধরার চেষ্টা করছেন। তাতেও ঘুমটা ঠিক কাটছে না। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে সে সত্যি লিখুক বা মিথ্যা লিখুক জগতের তাতে কিছু যায় আসছে না। সে ছবি কেমন এঁকেছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।