না, করি নাই। আল্লাহপাক তোর-আমার মতো না। তাঁর দিল বড়। পাপী লোক তার সামনে দাঁড়াইয়া একবার যদি বলে ভুল করছি মাপ দেন। তিনি মাপ দিবেন।
.
চিত্রার মাথার উপর দিয়ে দুটা বক ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। সে চমকে উঠল বকের ডাক শুনে। কী বিকট শব্দ। এমন সুন্দর পাখি! কী সুন্দর ধবধবে শাদা রং অথচ তার গলার স্বর ভয়াবহ। বকের ডাকে শুধু যে চিত্রা চমকে উঠেছে তা না, সঙ্গের মানুষটাও চমকে উঠেছে। মানুষটা এতক্ষণ শুয়ে ছিল। এখন উঠে বসেছে। অদ্ভুতভাবে চারদিকে দেখছে। মানুষটার শরীর মনে হয় খারাপ। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো হেলতে দুলতে এসে নৌকায় উঠল। চোখ টকটকে লাল। একটা চোখে পানি পড়ছে। নৌকায় উঠেই লোকটা শুয়ে পড়েছে। এতক্ষণ সে একবারও মাথা তুলে নি। বকের ডাকে এই প্রথম মাথা তুলল। লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তাকে চিনতে পারছে না। জ্বর খুব বেশি হলে এরকম হয়। চেনা মানুষকে অচেনা লাগে। আবার অচেনা মানুষকে মনে হয় খুব চেনা কেউ। চিত্রা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অসুস্থ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে না। তার মা বিছানায় শুয়ে কাতরায়। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সে মার ঘরে ঢুকে না। ঘরে ঢুকলেই হোসনে আরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। অভিশাপ দেন। কঠিন সব অভিশাপ। চিত্রা তাতে চিন্তিত হয় না কারণ মার অভিশাপ কখনো সন্তানের গায়ে লাগে না। দোয়া গায়ে লাগে অভিশাপ লাগে না। হাঁসের গায়ের পানির মত অভিশাপ ঝরে পড়ে যায়।
গতকাল ঘর থেকে বের হবার সময় হোসনেআরা কঠিন কিছু অভিশাপ দিলেন। চাপা গলায় বললেন, নিজের মারে এই অবস্থায় ফালাইয়া তুই রওয়ানা হইছস?
চিত্রা বলল, হুঁ। না যদি যাই উপাস থাকবা।
হোসনেআরা তখন কুৎসিত কিছু গালি দিলেন। গালির বিষয় হচ্ছে আশ্বিন মাসে মেয়েকুকুরের শরীর গরম হয়, সে তখন খুঁজে পুরুষ কুকুর। তার কন্যার শরীর সব মাসেই গরম থাকে। সে অভিনয় করার জন্যে যায় না। সে যায় শরীর ঠাণ্ডা করতে। সে আশ্বিন মাইস্যা কুকুরী না- সে বার মাইস্যা কুকুরী।
চিত্রা শান্ত মুখে গালি শুনেছে। তারপর বলেছে- মা, আমি ব্যবস্থা করে গেছি– তুমি ঠ্যাং কাটায়ে নিও।
হোসনেআরা তখন ভয়াবহ চিৎকার শুরু করলেন। চিত্রা মাকে এই অবস্থায় রেখে চলে এসেছে। সে যে-ব্যবস্থা করে এসেছে তাতে মনে হয় ঠ্যাং আজ কাটা হবে। মতি মামাকে বুঝায়ে দিয়ে এসেছে। হাতে টাকা পয়সা দিয়ে এসেছে। যে ডাক্তার ঠ্যাং কাটবেন চিত্রা তার সঙ্গেও কথা বলেছে। ডাক্তার সাহেবের কী সুন্দর চেহারা। হাসি খুশি। এই লোক মানুষের ঠ্যাং কাটে ভাবাই যায় না।
কাটা ঠ্যাং ডাক্তাররা কী করেন? ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে দেন? না-কি কবর দেয়া হয়?
ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। চিত্রা মাথা ঘুরিয়ে দেখল। লোকটা পানি খাচ্ছে। প্লাস্টিকের জগভর্তি পানি উঁচু করে মুখে ধরেছে। পানি গড়িয়ে লোকটার পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। চিত্রা বলল, আপনার শরীর খারাপ? লোকটা পানির জগ মুখ থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণে জন্যে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আবার পানি খেতে শুরু করল। চিত্রার প্রশ্নের জবাব দিল না।
চিত্রা বলল, আপনার কি জ্বর এসেছে?
লোকটা বলল, হু।
চিত্রা এগিয়ে গেল। একজন অসুস্থ মানুষের কাছে এগিয়ে যাওয়া যায়। কপালে হাত রেখে তার জ্বর দেখা যায়। এতে দোষের কিছু নেই। জ্বর খুব বেশি হলে মাথায় পানি ঢালতে হবে। সেটাও কোন সমস্যা না। তারা পানির উপর দিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়ালেই পানি।
চিত্রা কপালে হাত রাখতে গেল। মাহফুজ একটু সরে গিয়ে বলল, গায়ে হাত দিও না।
চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আমার কি কুষ্ঠ হয়েছে যে আপনার গায়ে হাত দিতে পারব না?
মাহফুজ বলল, দরকার কী?
চিত্রা বলল, দরকার আছে।
জ্বর বেশি বললে কম বলা হয়- মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরে গ্যাসের একটু চুলা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। চুলার আগুনে চামড়ার নিচের রক্ত ফুটছে।
চিত্রা বলল, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন- আমি মাথায় পানি ঢালব।
মাহফুজ বলল, বাজে ঝামেলা করবে না। দরকার নাই।
দরকার আছে কি-না আমি দেখব। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
মাহফুজ নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলল, তোমার নাম কি?
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, নাম জিজ্ঞেস করেন কেন? নাম তো জানেন। চিত্রা।
চিত্রা তো নকল নাম। আসল নাম কি?
আসল নাম, নকল নাম– কোনটায়ই আপনার দরকার নাই। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
তুমি পড়াশুনা কতদূর করেছ?
অল্প অ-আ জানি।
কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ? এত কথা বলছেন কেন? আপনাকে-না শুয়ে থাকতে বললাম।
মাহফুজ ঘোর পাওয়া মানুষের মতো আবারও একই প্রশ্ন করল তুমি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?
ক্লাস টেন।
সায়েন্স না আর্টস?
আর্টস।
ভাল হয়েছে। তুমি আমাদের স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে পারবে।
আপনি শুয়ে পড়েন।
জ্বি আচ্ছা।
চিত্রা হকচকিয়ে গেল। মানুষটা জ্বি আচ্ছা বলছে কেন? জ্বর যখন খুব বাড়ে তখন শরীরের তাপ মাথার মগজে ঢুকে যায়। তখন মানুষ অদ্ভুত কথা বলে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে।
মাহফুজ শুয়ে পড়েছে। তার চোখ খোলা। অবাক হয়ে সে চারদিক দেখছে। চিত্রার ভয় ভয় লাগছে। মানুষটা মরে যাবে না তো? যদি সত্যি সত্যি মরে যায় সে কী করবে। নৌকা ঠাকরোকোনা স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর লাশ ফেলে রেখে স্টেশনের দিকে যাবে। ময়মনসিংহ যাবার ট্রেন কখন কে জানে। এটা করা কি সম্ভব?