চিত্রা ইনজিন থেকে দূরে থাকার জন্যেই নৌকার প্রায় মাথায় বসে আছে। রোদ খুবই কড়া। চিত্রা মাথায় ছাতা ধরে আছে। মনে হচ্ছে ছাতাও রোদ আটকাতে পারছে না।
মাঝি বলল, ছাত্তিটা গাঙের পানিতে ভিজাইয়া লনগো আফা। মজা পাইবেন।
ছাতা রোদ আটকাবার জন্যে। এর মধ্যে মজা পাবার কী আছে কে জানে। চিত্রা পানিতে ছাতা ভিজিয়ে নিল। তেমন কোন মজা পাওয়া যাচ্ছে না। ভেজা ছাতা থেকে পানি গড়িয়ে শাড়িতে পড়ছে- শাড়ি নোংরা হচ্ছে এটাই রোধ হয় মজা।
চিত্রা নদীর দুপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো কোন দৃশ্য না। কিছু মানুষ মাছ মারছে। জাল ফেলছে, তুলছে– জালে কোন মাছ দেখা যাচ্ছে না। ক্লান্তিকর কাজটা তারা করেই যাচ্ছে।
নদীর পানিতে মহিষ নামানো হচ্ছে। গরুকে গোসল দেয়া হচ্ছে। কিছু ছেলেপুলে পানিতে ঝাপাঝাপি করছে। ঘুরেফিরে একই দৃশ্য। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ ক্লান্ত হয়। চোখ ক্লান্ত হলেই মন ক্লান্ত হয়। তখন ঘুম-ঘুম পায়। তবে নদীর দুধারেই প্রচুর কাশফুল ফুটেছে। দূর থেকে কাশফুল দেখতে ভাল লাগছে। চিত্রার সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে সে অবশ্যই কাশফুলের ছবি তুলতো। সস্তা ধরনের একটা ক্যামেরা তার আছে। সে যখন বাইরে যায়, ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে যায়। এবারই শুধু আনা হয় নি কারণ ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া যায় নি। চিত্রার ধারণা তার মা ক্যামেরাটা গোপনে বিক্রি করে দিয়েছেন। মহিলা এই ধরনের কাজ প্রায়ই করেন। ঘরের টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে দেন। কাজটা নিরুপায় হয়েই তাঁকে করতে হয়। তারপরও চিত্রার ভাল লাগে না। ক্যামেরাটা তার খুব শখের ছিল। মহিলাকে যদি সে জিজ্ঞেস করে- মা ক্যামেরা বিক্রি করলে কেন? সেই মহিলা তখন খুবই ওজনদার কোন কথা বলবেন। ওজনদার কথা বলতে এই মহিলা খুব পছন্দ করেন। ওজনদার কথা বলবার সময় তিনি আবার চোখে চশমা পরে নেন। চশমা পরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গলার স্বরও বদলে যায়।
চিত্রার আসল নাম- মেহের বানু। ডাক নাম বানু। তার নাটকের নাম সুচিত্রা। সুচিত্রা থেকে চিত্রা। নাটকের জন্যে সুচিত্রা নাম তার মায়ের রাখা। সুচিত্রা-উত্তমের সুচিত্রা। মফঃস্বল থেকে কেউ যখন তাকে নিতে আসে তখন তার মা চোখে চশমা পরে গম্ভীর ভঙ্গিতে পার্টির সঙ্গে কথা বলতে বসেন। পার্টির বয়স যাই হোক, তিনি কথা শুরু করেন তুমি সম্বোধনে।
বুঝছ বাপধন, আমার মেয়ের ভাল নাম সুচিত্রা। সুচিত্রা-উত্তমের সুচিত্রা। তার অভিনয় যখন দেখবা তখন বুঝবা নাম তার সার্থক। বৃক্ষরে যদি জিজ্ঞাস কর বৃক্ষ তোমার নাম কি? বৃক্ষ বলে– ফলে পরিচয়। আমার কন্যারও ফলে পরিচয়।
কয়েকটা কথা বাপধন তোমারে আগেভাগে বলি– সুচিত্রারে তোমরা দিবা এক হাজার এক টেকা। পুরা টেকা আমার হাতে বুঝাইয়া তারপর তারে নিবা। বাকির নাম ফাঁকি। টাকা আছে? আন নাই? পরে দিবা? আইচ্ছা তাইলে যাও। আল্লাহ হাফেজ।
এই বলেই তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেন। অর্থাৎ তার কথা শেষ। পার্টি যদি বলে টাকা তারা এনেছে তবে এত আনে নাই- একটু কমাতে হবে তখন তিনি আবারও চশমা পরেন আবারও কথাবার্তা শুরু হয়। আবারও এক পর্যায়ে কথা বন্ধ হয়। তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলে দুঃখিত গলায় বলেন, শোন বাপধন, আমি কি মাছ বেচতে বসছি? আমি মাছের একটা দাম বললাম, তুমি বলো আরেকটা। শুরু হইল মূলামূলি। সুচিত্রারে তোমার নেওনের দরকার নাই। তুমি মাছ-হাটা থাইক্যা একটা চিতল মাছ কিইন্যা লইয়া যাও। এই দামে তুমি ভাল চিতল মাছ পাইবা। নয়া আলু আর টমেটো দিয়া চিতল মাছ বড়ই স্বাদ।
একসময় দরদাম ঠিক হয়। চিত্রার মা পার্টির হাত থেকে টাকা নিয়ে গুনতে বসেন। খুশি খুশি গলায় বলেন- ও চিত্রা ইনারারে চা দে। হুদা মুখে বইস্যা আছে। পার্টি যত আপত্তিই করুক চা না খেয়ে তারা উঠতে পারে না। চা খাবার সময় তিনি নানান ধরনের মজার মজার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে প্রয়োজনীয় কিছু কথাও সেরে নেন- একটা কথা বলতে ভুইল্যা গেছি বাপধন। আমিও কিন্তু মেয়ের সঙ্গে যাব। আমার জোয়ান মেয়ে আমি একলা ছাড়ব না। তোমরার উপরে আমার বিশ্বাস আছে। দেইখ্যাই বুঝতেছি তোমরা ভালোমানুষের পুলাপান। আমার মেয়ের উপরে বিশ্বাস নাই। দুইটা জিনিসরে বিশ্বাস করণ নাই- জোয়ান কন্যা আর কালসর্প। আমার কথা না বই পুস্তকের কথা।
.
চিত্রার মা চিত্রাকে কখনো একা ছাড়েন নি। এখন ছাড়ছেন কারণ এখন তার মেয়ের সঙ্গে আসার উপায় নেই। তার বা পায়ে কী যেন হয়েছে- পা মাটিতে ছুঁয়াতে পারেন না। অসহ্য যন্ত্রণা। ওষুধপত্রে এই যন্ত্রণা কমে না– শুধু যখন সিগারেটের শুকা ফেলে সেখানে গাঁজা পাতা ভরে টানেন তখন ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে আসে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। মেডিকেল কলেজের ভাল ডাক্তার। তিনি বলেছেন– হাসপাতালে ভর্তি হতে। হাঁটু পর্যন্ত কেটে বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই। চিত্রার মা রাজি হন নি। তিনি রাগি গলায় চিত্রাকে বলছেন– রোজ হাশরের দিন আমি আল্লাহপাকের সামনে এক ঠ্যাং নিয়া খাড়ামু? তুই কস কি? সবেই হাসতে হাসতে দৌড় দিয়া বেহেশতে ঢুকব আর আমি ল্যাংটাইতে ল্যাংচাইতে যামু?
তুমি বেহেশতে যাইবা?
অবশ্যই।
বেহেশতে যাওনের মতো সোয়াব তুমি করছ?