মাহফুজ ঘর থেকে বের হল। তার হাতে একগাদা পাটখড়ি। পাটখড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মশাল নিয়ে বের হয়েছে। মাহফুজ ঘর থেকে বের হয়েই চিৎকার করে বলল, কে কোথায় আছেন। আসেন দেখি আমার সাথে। আমি মাহফুজ।
চিত্রা লক্ষ্য করল একজন দুজন করে আসছে। মাহফুজ আবারও চিৎকার করে ডাকল- কই আসেন। ঘরে বসে থেকে লাভ নাই। বের হন।
.
রানু ফিসফিস করে বলল, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ছদরুল বেপারী জবাব দিলেন না। হাসলেন। তাঁর চোখ-কান খোলা, হাঁটছেন কুঁজো হয়ে। তার মন বলছে দূর থেকে তাঁকে কেউ লক্ষ্য করছে। যে লক্ষ্য করছে সে একা বলেই কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে যাচ্ছে তার দল নিয়ে আসতে। রানু মেয়েটাকে অতি দ্রুত মওলানা ইস্কান্দার আলির হাতে তুলে দিয়ে তাকে অন্ধকারে মিশে যেতে হবে। সবচে ভাল হয় পাঞ্জাবী খুলে খালি গা হয়ে গেলে। নগ্ন-গাত্রের মানুষ অন্ধকারে চোখে পড়ে না।
ছদরুল বেপারী বললেন, তুমি দৌড়াতে পারবা?
রানু বলল, আমি হাঁটতেই পারছি না, দৌড়াব কিভাবে?
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যেভাবে যাইতেছ সেভাবেই যাও। ছদরুল বেপারী একটা ব্যাপার ভেবে সামান্য আনন্দ পাচ্ছেন তার হাতে যেমন সময় নেই, যারা তাঁকে খুঁজছে তাদের হাতেও সময় নেই। ঝড়ের প্রথম ঝাপটা পার হয়ে গেছে। সাধারণত প্রথম ধাক্কায় কিছু না হলে পরে আর হয় না। তিনি নিশ্চিত এর মধ্যে তাঁর নিজের জায়গায় খবর চলে গেছে। তার লোকজন ছুটে আসছে। মাহফুজ বের হয়েছে। তিনি তার গলা শুনতে পেয়েছেন। সে লোকজন সংগ্রহ করছে।
তাঁকে দাবা খেলায় আর কিছুক্ষণ টিকে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ টিকতে পারলেই হাতি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত চলে আসবে। তখন তিনি হাতীর চাল দেবেন না, সৈন্যও এগিয়ে দেবেন না। তিনি দেবেন ঘোড়ার চাল। ছদরুল বেপারীর ঘোড়ার চাল কি লোকজন দেখবে। ভুজঙ্গ বাবুর পাটের চেয়ে সেটা খারাপ হবে না। ভাল কথা, তিনি ভুজঙ্গ ব্যাটাকেও ধরে আনাবেন। স্কুলের মাঠে নাটক হবে। ভুজঙ্গকে টিপু সুলতানের পাট করতে হবে। তিনি নিজের হাতে ভুজঙ্গকে সোনার মেডেল পরিয়ে দেবেন। তবে তার আগে ভুজঙ্গকে একশ বার কানে ধরে উঠ-বস করাবেন। ভুজঙ্গ সোনার মেডেলের কথা সবাইকে বলে বেড়াবে কিন্তু কানে ধরে উঠ-বসের কথা কাউকে বলতে পারবে না।
মানুষ তার জীবনের সব ঘটনা বলতে পারে না। কিছু কিছু ঘটনা চেপে যায়। তিনি বলতে পারেন। কারণ তিনি ঠিক মানুষ শ্রেণির না, পশু শ্রেণির। এক সময় তার মা দেওয়ানগঞ্জে ঘর নিয়ে নটি-বেটি হয়েছিলেন এই কথা বলতে তার মুখে আটকায় না। তবে মায়ের উপর তার কোন রাগ নাই। স্বামীর মৃত্যুর পর এই মহিলা দুধের শিশু নিয়ে মরতে বসেছিলেন। কেউ তাকে খাওয়া দেয় নাই। সে শিশু-সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরেছে। দেওয়ান গঞ্জের লোকজন তাঁর কাছে এসেছিল একটা মাদ্রাসা হবে, গার্লস স্কুল হবে তার জন্যে সাহায্য। তিনি সাহায্য করেছেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল বলেন আমার মাকে তোমরা বাজারের নটি-বেটি বানিয়েছিলে। তার শাস্তি হিসেবে দেওয়ানগঞ্জের সবাই মিলে দশ বার কান ধরে উঠ-বোস কর। আমি মাদ্রাসা বানিয়ে দিব, মসজিদ বানায়ে দিব, স্কুল-কলেজ করে দিব। পাকা রাস্তা বানিয়ে দিব। তিনি তা বলেন নাই। তিনি ক্ষমা করেছেন। মাঝে-মধ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মানুষকে ক্ষমা করতে হয়।
রানু বলল, আর কতদূর?
ছদরুল বেপারী বললেন, ঐ তো দেখা যায়। বারান্দায় ইস্কান্দার মওলানা বসে আছে। তুমি কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকে যাবে। ঘরের ভিতর কুপী জ্বলতেছে। ফুঁ দিয়ে কুপী নিভায়ে দিবে। ইস্কান্দার মওলানার সঙ্গে কথা যা বলার আমি বলব।
.
মওলানা ইস্কান্দার আলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ছদরুল বেপারী বললেন, মেয়েটাকে রেখে গেলাম। ঝামেলা মিটলে তাকে পৌঁছায়ে দিবেন। বুঝতে পারতেছেন কি বললাম?
মওলানা ইস্কান্দার বিড়বিড় করে বললেন, জনাব আমার একটা খবর ছিল। আনন্দের খবর।
ছদরুল বেপারী বললেন, খবর শোনার সময় নাই। যা বললাম করবেন।
খুবই বড় একটা সংবাদ জনাব। আমি পাক কোরাণ মুখস্থ করেছি। আমার নাম এখন হাফেজ ইস্কান্দার আলি।
যাই হাফেজ সাহেব।
চাইরদিকে আগুন লাইগা গেছে ব্যাপারটা কি জনাব?
ছদরুল বেপারী ব্যাপার বলার সুযোগ পেলেন না। মওলানা ইস্কান্দারের উঠানে তিনজন এসে দাঁড়াল। তিনজনের একজনের নাম কুদ্দুস। কুদুসের হাতে খোলা পিস্তল। কুদুসের পাশেই কানা রফিক। কানা রফিকের গায়ে হলুদ রঙের চাদর! চাদরে সে মাথা ঢেকে রেখেছে। তার চোখ জ্বল জ্বল করছে। কানা রফিক একদলা থুথু ফেলল। ছদরুল বেপারী শান্ত গলায় বললেন, কুদ্দুস তুমি কি চাও?
কুদ্দুস গলা খাকারি দিল।
কানা রফিক চাপা গলায় বলল, কুদ্দুস দেরী করতেছ কেন? হাতে সময় সংক্ষেপ।
কুদ্দুস পিস্তল উঁচু করে এক পা এগিয়ে আসতেই মওলানা ইস্কান্দার আলি তার সামনে দুহাত তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর্তনাদের মত চেঁচিয়ে উঠলেন– কি করতেছ? কি সর্বনাশ! তোমরা কি করতেছ?
তাঁর চিৎকার ছাপিয়ে পরপর দুবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ হল। দূর থেকে হৈচৈ চিৎকার শোনা যাচ্ছে। মাহফুজ তার বিশাল দল নিয়ে এদিকেই আসছে। তারা গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে।
.
হাফেজ মওলানা ইস্কান্দার আলির উঠান ফাঁকা। তিনি উঠানে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর বুক থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মওলানার পাশেই ছদরুল বেপারী। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। মওলানার ঘরের দরজা ধরে রানু দাঁড়িয়ে আছে। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, উনার কি হয়েছে?