ছদরুল বেপারী পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পান বের করে মুখে দিলেন। কুদুসের এনে দেয়া কাঁচাসুপারির পানগুলো কাজে লাগছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পান চিবুতে মজা লাগছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট খাওয়া যাবে না। সিগারেটের আগুন দূর থেকে দেখা যাবে।
শুকনো পাতায় মড় মড় শব্দ করে কে যেন আসছে। অন্য সময় হলে ছদরুল বেপারী বলতেন– কে আসে? আজ কিছু বললেন না তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। না ভয় পাবার কিছু নেই। যে আসছে সেই বরং ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বার বার থেমে পড়ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে এখন চেনা যাচ্ছে। সুলতান সাহেবের মেয়ে। ভয়ে মেয়েটার মুখ ছোট হয়ে গেছে। মেয়েটা এখন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটা একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আকাশে সে কি দেখার চেষ্টা করছে? চাঁদ?
ছদরুল বেপারী গলা খাকারি দিলেন। রানু কান্না কান্না গলায় বলল, কে? গাছের ওপাশে কে?
ছদরুল বেপারী গাছের আড়াল থেকে বের হতে হতে বললেন, আমারে তুমি চিনবা না। আমার নাম ছদরু।
রানু বলল, আমি আপনাকে চিনব না কেন? আমি আপনাকে খুব ভাল করে চিনি। আপনার নাম ছদরুল বেপারী। শুনুন আপনি আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আসুন।
ছদরুল বেপারী বললেন, আমি এইখানে থেকে বের হতে পারব না। লোকজন আমারে খুঁজতাছে।
আপনাকে খুঁজছে কেন?
খুন করার জন্যে খুঁজতেছে।
কি আশ্চর্য! কেন?
ছদরুল বেপারী হেসে ফেললেন। এগিয়ে এলেন রানুর কাছে। মেয়েটা বোকার মত খোলা জায়গায় দাঁড়িয়েছে আছে। চাঁদের আলো পড়েছে তার গায়ে। অনেক দূর থেকে দেখা যাবে।
তোমার নাম কি?
আমার নাম রানু।
একটু আগায়ে অন্ধকারে দাঁড়াও।
কেন?
এত কেন কেন করবা না। যা বলতেছি কর।
আপনি এরকম করে কথা বলছেন কেন?
কি রকম করে কথা বলতেছি?
কেমন যেন অন্যরকম করে কথা বলছেন। তবে আপনাকে দেখে আমার ভয় কেটে গেছে। আমি আসলে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। আপনি কি জানেন চার-পাঁচটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
জানি।
পুলিশ কখন আসবে? গণ্ডগোল থামবে না?
আমারে যদি মারতে পারে তাহলে গণ্ডগোল থামবে। তবে আমাকে মারা সহজ না। আমি বিরাট খেলোয়াড়।
ছদরুল বেপারী ভুরু কুঁচকে ফেলল। মেয়েটা না থাকলে তার কোন সমস্যা ছিল না। মেয়েটা তাঁকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েটাকে ফেলে তিনি চলে যেতে পারছেন না। এই সময় আগুনের মত রূপবতী একটা মেয়ের সঙ্গে থাকা খুবই বিপদজনক ব্যাপার।
রানু কিছু বলতে যাচ্ছিল ছদরুল বেপারী হঠাৎ তার মুখ চেপে ধরলেন। মশাল জ্বালিয়ে চার-পাঁচ জন লোক আসছে। এদের দুজনের হাতে বর্শা। রানুর ভয় কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ প্রবল ভয় তাকে অভিভূত করে ফেলল। তার কাছে মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে।
ছদরুল বেপারী ফিসফিস করে বলল, ভয় নাই আমি জীবিত থাকতে তোমার কিছু হবে না। জীবিত কতক্ষণ থাকব এইটা হইল কথা। এরা আমারে খুঁজতেছে। এদের একজন আমার খুব আপন লোক। নাম কুদ্দুস।
রানু বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে চলুন। আমি আপনাকে লুকিয়ে রাখব।
তোমারে তোমার বাড়িতে নিয়া যাব। তবে তোমার বাবা সুলতান সাহেব আমারে জায়গা দিবে না।
অবশ্যই দেবেন। কি বলছেন আপনি?
ছদরুল বেপারী ক্লান্ত গলায় বললেন, দিলে তো ভালই। চল জঙ্গলের ভিতর দিয়া হাঁটি। আস্তে পা ফেলবা যেন শব্দ না হয়।
রানু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমার হাত ধরে নিয়ে যান। আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে।
ছদরুল বেপারী তার দীর্ঘ জীবনে কোন তরুণীকে মা ডাকেন নি হঠাৎ তার কি মনে হল, তিনি বললেন, মা হাতটা ধর। বললাম না আমি জীবিত থাকতে তোমার কোন ভয় নাই। মরে গেলে ভিন্ন কথা। মরে গেলে তুমি চলবা তোমার নিজের দিশায়।
বেশিদূর যাওয়া গেল না। মশাল হাতে দলটা আবার ফিরে আসছে। ছদরুল বেপারী মওলানা ইস্কান্দার আলির বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মেয়েটাকে মওলানার হাতে তুলে দিয়ে তাকে দ্রুত সরে পড়তে হবে। হাতে সময় বেশি নেই।
.
মাহফুজ তার বাড়ির উঠোনের জলচৌকিতে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একজন মৃত মানুষ। সে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। তার সামনে চিত্রা এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে সে চিত্রাকে দেখতে পাচ্ছে না। চিত্রা বলল, অবস্থা খুবই খারাপ। একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছে। আপনি বসে থাকলে তো হবে না। মাহফুজ বলল, আমি কি করব? আমার এখন কি করার আছে?
আপনি বাড়ি থেকে বের হবেন। আপনার নিজের লোক জোগাড় করবেন। আপনি আগাবেন আপনার দল নিয়ে।
দল কোথায় আমার?
একেকটা বাড়ির সামনে দাঁড়াবেন। তাদের ডাকবেন। অবশ্যই তারা বের হবে। আপনাকে এই গ্রামের মানুষ অসম্ভব পছন্দ করে। আপনার ডাক তারা শুনবে।
আমার মাথা ঘুরছে চিত্রা। আমি উঠে দাঁড়িতে পারছি না।
আপনি আপানকে হাত ধরে নিয়ে যাব।
মাহফুজের মাথার ভেতর তার দাদী কথা বলে উঠলেন– ও আবু এই মেয়েটা যেন তোরে ছাইড়া না যায়। অতি অবশ্যই এরে তুই বিবাহ করবি। ঝামেলা মিটলে আইজ রাইতেই। ইস্কান্দার মওলানারে ডাক দিয়া আইন্যা বিবাহ করবি। এইটা তোর উপর আমার হুকুম। ঐ বেকুব আমার কথা শুনতেছস?
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, চুপ কর।
আমার কথা না শুনলে নাই। মেয়েটা কি বলতাছে শোন। হে কোন ভুল কথা বলতাছে না।