সুলতান সাহেব একতলায় নামলেন। একতলা থেকে বাড়ির সামনের বাগানে গেলেন। হৈচৈ এবং চিৎকার স্পষ্ট হল। উত্তর দিকের আকাশ লাল হয়ে আছে। কোথাও আগুন লেগেছে। তিনি গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। সামনের রাস্তা দিয়ে কে যেন ছুটে গেল। একটা ক্রাইসিস তৈরী হয়েছে। ক্রাইসিসের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। উত্তেজিত হওয়া যাবে না। তার অসুস্থ মেয়েটা সেখানে আছে। বড় ক্রাইসিস সুস্থ মানুষ একভাবে দেখে অসুস্থ মানুষ একভাবে দেখে। তাকে এখন যা করতে হবে তা 2602- Taking notes is not the most intellectual job in the world. But during crises only thing you can do is taking notes.
এটা কার কথা? মার্ক টোয়েনের? কে যেন ছুটে আসছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি গেট খুলে বাইরে এলেন। যে আসছে তাকে থামাতে হবে। তিনি কড়া গলায় বললেন, কে? কে?
পায়ের শব্দ থেমে গেল। যে এগিয়ে এল তাকে তিনি চেনেন না। তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি না চিনলেও সে নিশ্চয়ই তাঁকে চেনে।
তোমার নাম কি?
আমার নাম বিষ্ণু।
হৈচৈ কিসের?
একটা মাডার হয়েছে।
কে মার্ডার হয়েছে?
বলতে পারব না।
আগুন কিসের?
ইস্কুল ঘরে আগুন লাগাইয়া দিছে।
গণ্ডগোলটা কি নাটকের মাঝখানে শুরু হয়েছে?
নাটক হয় নাই।
আমার মেয়েটাকে দেখেছ? রানু নাম?
উনারে চিনি। জ্বে না উনারে দেখি নাই।
তুমি দৌড়ে যাচ্ছ কোথায়?
শুনতাছি রায়ট হইব। সব হিন্দুবাড়ি জ্বালায়ে দিব।
রায়ট হবার কি আছে? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।
বিষ্ণু ছুটে যাচ্ছে রায়ট হবার সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা অকারণে নির্যাতিত হয়। যে কোন সমস্যার প্রথম বলি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
পূর্বদিকের আকাশ আরো লাল হয়েছে। মনে হয় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সুলতান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন– Taking notes is not the most intellectual job in the world… :
একদল মানুষ দৌড়ে আসছে। তাদের হাতে মশাল না-কি? মশাল মিছিল শহুরে ব্যাপার। গ্রামের মানুষ মশাল পাবে কোথায়? গ্রামের মানুষদের হাতে থাকে টর্চলাইট। সুলতান সাহেব এক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। গুলির শব্দ হল। একবার, দুবার, তিনবার। গাছপালার যত পাখি সব এক সঙ্গে ডেকে উঠল। সুলতান সাহেব চাপা গলায় ডাকলেন রানু, রানু, ও রানু। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন তার পায়ে স্যান্ডেল নেই। তিনি খালি পায়ে দৌড়াচ্ছেন।
.
মওলানা ইস্কান্দার আলি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর কোরাণ শরীফ পাঠ শেষ হয়েছে। তিনি পুরোটা মুখস্থ বলতে পেরেছেন। তাঁকে রেলের উপর রাখা কোরাণ শরীফের পাতায় চোখ বুলাতে হয় নি। তাঁর কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। উত্তেজনায় তাঁর বুক উঠানামা করছে। তার উচিত এই মুহূর্তে শোকরানা নামাজে দাঁড়ানো। কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। মনে হচ্ছে শরীরে কোন জোর নেই। ইস্কান্দার আলি বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। তাঁর চোখ শুকনো কিন্তু তিনি কাঁধে রাখা গামছায় একটু পর পর চোখ মুছছেন। বাইরে প্রচণ্ড হৈ চৈ হচ্ছে, সেই হৈ চৈ-এর কিছুই তার কানে ঢুকছে না। তাঁর মনে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে কোরাণ মজিদ পুরোটা মুখস্থ তিনি বলেছেন, কিন্তু পরে যদি তিনি আর না পারেন। যদি এমন হয় যে নামাজে দাঁড়িয়ে সূরার মাঝামাঝি জায়গায় সব ভুলে যান। তখন কি হবে? হাফেজ নুরুদ্দিন সাহেবের জীবনে এই ঘটনা ঘটেছিল। হাফেজ সাহেবের বাড়ি কুমিল্লার গুণবতী গ্রামে। তিনি ছিলেন হাফেজ ও ক্বারি। অতি সুকণ্ঠ। কোরাণ মজিদ পুরোটা ছিল কণ্ঠস্থ। শুধু নামাজে দাঁড়ালে সব গণ্ডগোল হয়ে যেত। এমনও হয়েছে সূরা ফাতেহার মাঝামাঝি এসে তিনি আটকে গেছেন। এমন ভয়ংকর কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে না তো? ইস্কান্দর আলির পানির পিপাসা হচ্ছে কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনার মত শক্তি তাঁর নেই। অবসাদ, উত্তেজনা আনন্দ এবং ভয়ে তার শরীর যেন কেমন করছে…
.
ছদরুল বেপারী একটা গাছের আড়ালে আছেন। পুরানো জামগাছ। এই গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব। তিনি তার গায়ের শাদা চাদরটা ফেলে দিয়েছেন। অন্ধকারে শাদা রঙ চোখে পড়ে। নিজেকে লুকিয়ে ফেলা এখন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন গণ্ডগোলটা হচ্ছে তাঁর জন্যে। কানা রফিকের দল আসলে তাঁকে খুঁজছে। কাজ উদ্ধারের জন্যে হঠাৎ একটা ঝামেলা তৈরী হয়েছে। নিরীহ একজন মানুষ মারা পড়েছে। ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্ট। গণ্ডগোলটা শুরু হয়েছে এইভাবে- কানা রফিক ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্টকে শার্টের কলার ধরে স্কুলের মাঠ থেকে একটু দূরে এনে বলেছে- তোর ওস্তাদ আসল না ক্যান।
অল্প বয়স্ক ছোকরা অ্যাসিসটেন্ট হয়ত এর উত্তরে অপমানসূচক কিছু বলেছে। কানা রফিককে সুযোগ করে দিয়েছে। কানা রফিক থমথম গলায় বলেছে- শুওরের বাচ্চা দেহি আমারে বাপ তুইল্যা গাইল দেয়। শুওরের বাচ্চারে একটু টিপা দিয়ে দেও দেহি। এই বলে নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে তাকে অন্যদের হাতে দিয়ে উঠে এসেছে। তারপরই স্কুলঘরে আগুন লেগে গেছে। স্কুলঘরে আগুন লাগানোর একটা উদ্দেশ্য ঝামেলা ছড়িয়ে দেয়া। ছদরুল বেপারী পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন গ্রামের চারদিকে পাহারা বসেছে। তিনি তখনই নিজের গা থেকে শাদা চাদর খুলে ফেললেন। আর সময় নেই লুকিয়ে পড়তে হবে। প্রথম থেকেই অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর নিজের দল এই ঝামেলার সঙ্গে যুক্ত। যতই সময় যাচ্ছে তার ধারণা ততই স্পষ্ট হচ্ছে। তাঁর দলের লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কখনোই এক সঙ্গে নেই। কানা রফিকের সঙ্গে কুদ্দুসকে আলাপ করতেও দেখলেন। দুজন একসঙ্গে সিগারেট ধরাল। দাবার খেলা শুরু হয়েছে। খুবই জটিল খেলা। তিনি নিজেই রাজা নিজেই মন্ত্রী। তবে রাজা মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর হাতী-ঘোড়া তার দিকেই ছুটে আসছে। এটা খারাপ না। খেলতে হলে এরকম খেলাই খেলা উচিত।