দুই. আপনি আপনার অসুখটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আপনি যেমন রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বানাচ্ছেন– আপনার অসুখটাও আপনার মাথার ভেতর বসে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বানাচ্ছে।
তিন. আমি অভিনেত্রী মানুষ তো। অভিনয় করে নানান সময়ে নানান কথা বলি। আপনি যেমন সবসময় সত্যি কথা বলেন আমিও তেমন সবসময় মিথ্যা কথা বলি। সত্যি কথা বলে বলে আপনার হয়ে গেছে। অভ্যাস তেমনি মিথ্যা কথা বলে বলে আমার হয়ে গেছে অভ্যাস। আপনাকে বলেছিলাম না ছদরুল বেপারীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি নাটকের পর তার সঙ্গে চলে যাব। দশ হাজার টাকা পাব। কথাটা মিথ্যা। কেন বলেছি জানেন? আমার কথাটা শুনে আপনি মনে কষ্ট পান কি-না দেখার জন্যে। আমি জানতাম আপনি কষ্ট পাবেন। কিন্তু এতটা কষ্ট পাবেন ভাবি নি।
চার. আমি তো আগেই বলেছি আমি মিথ্যা কথা বলি। এবং সুযোগ পেলেই একটু অভিনয় করে ফেলি। বলেছিলাম না আমার পায়ে কাঁটা ফুটেছে? আসলে মিথ্যা। আমি কাঁটা ফুটার অভিনয় করেছি। তবে অভিনয়টা জোরাল করার জন্যে সেফটিপিন দিয়ে খোঁচাখুচি করাটা খুব ভুল। তখন সত্যিকারই ব্যথা পেয়েছি। এটা করা ঠিক হয় নি। কাটার ফুটার অভিনয় কেন করলাম? আপনি বুদ্ধিমান হলে নিজেই বুঝতেন কেন করেছি। যেহেতু আপনি বুদ্ধিমান না, আমি বলে দিচ্ছি। কাঁটা ফুটার। অভিনয় করলাম যাতে আমি আপনার হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটতে পারি। রাগ করবেন না। সত্যি কথাটা বললাম। আমি খুবই খারাপ মেয়ে। অভিনয়ের বাইরেও আমাকে অনেক কিছু করতে হয়। নষ্ট মেয়েদেরও তো মাঝেমধ্যে মন কেমন করে। কারোর হাত ধরতে ইচ্ছা করে। করে না?
পাঁচ. আপনি ভুলেও ভাববেন না যে আপনাকে ভুলাবার জন্যে এইসব কথা বলছি। পুরুষ মানুষকে আমি মিষ্টি কথা দিয়ে ভুলাই না, শরীর দিয়ে ভুলাই। এরকম আঁৎকে উঠবেন না। আঁৎকে উঠার মত কিছু বলি নি।
চিত্রা মাহফুজের গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিল। তখনি ঘরে ঢুকল সামছু। সামছু খানিকটা উত্তেজিত এবং ভয়ংকর চিন্তিত। কারণ ভুজঙ্গ বাবু আসেন নি। শেষ মুহূর্তে খবর দিয়েছেন আসতে পারবেন না। সামছু মাহফুজকে ডেকে তুলতে গেল। চিত্রা চাপা গলায় বলল, খবর্দার উনাকে ডাকবেন না। ঘুমুচ্ছে ঘুমুতে দিন। যা বলার ঘুম ভাঙ্গার পর বলবেন।
মাহফুজ ভাইরে এখন দরকার।
দরকার হলেও উনাকে ডাকা যাবে না। আপনি বাইরে আসুন। উঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।
তারা উঠানে দাঁড়াল। সামুছ বলল, খুবই ভয় লাগতাছে। মনে হইতেছে বিরাট ঝামেলা হইব। মাহফুজ ভাইকে এক্ষণ দরকার। কানা রফিক তার দলবল নিয়া আসছে। কেন আসছে বুঝতেছি না।
চিত্রা বলল, যার ইচ্ছা সে আসুক। কানা রফিকটা কে?
টেকা নিয়া মানুষ খুন করে।
মানুষ খুন করতে কত টাকা নেয়?
মানুষ বুইজ্যা দাম। পাঁচশ টাকার মানুষ আছে। আবার ধরেন লাখ টেকার মানুষও আছে।
চিত্রা বলল, আপনি, স্কুল ঘরে থাকেন। উনার ঘুম ভাঙলেই আমি উনাকে নিয়ে চলে আসব। ভুজঙ্গ বাবু নেই তো কি হয়েছে? প্রমোটারকে টিপু সুলতানের ড্রেস পরে দাঁড় করিয়ে দেব। মফঃস্বলের নাটকে এরকম প্রায়ই হয়। এটা কোন ব্যাপার না।
.
চিত্রার খুব ক্লান্তি লাগছে। আজ নাটক না হলে ভালই হয়। তার ঘুম পাচ্ছে। নাটকের ঝামেলা না থাকলে সে শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে। সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় হাঁটতে ভাল লাগছে। নাটক নিয়ে তার মাথায় কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। নাটক হবে কি হবে না এই দায়িত্ব তার না। সে তৈরী হয়েই আছে। যখন তার ডাক পড়বে সে মঞ্চে উঠে যাবে। সে তার অংশটা শুধু যে ভাল করবে তা না খুবই ভাল করবে। টিপু সুলতানের ডায়লগ শেষ হবার আগেই তার প্রবেশ। টিপু একা একা কথা বলছেন
টিপু : পলাশীর বিষবৃক্ষ। মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠের দল স্বহস্তে রোপন করেছিল যে বিষবৃক্ষ- মীরমদন, মোহনলালের বক্ষ-রক্তে তো ভেসে গেল তবু সে বিষবৃক্ষের মূল শিথিল হল না।
এই সময় সোফিয়া ঢুকবে। টিপু সুলতানকে চমকে দিয়ে বলবে—
সোফিয়া : হায়দার আলি খাঁ বাহাদুর এবং ফতে আলি টিপুও বুকের রক্ত ঢেলে সে বিষবৃক্ষকে উৎপাটিত করতে পারবেন না।
টিপু : কে! কে কথা কইলে! কে তুমি?
সোফিয়া : বাদির নাম সোফিয়া
টিপু : সোফিয়া বালিকা তুমি কি করে জানলে ইংরেজ বিজয়ে আমরা অক্ষম!
সোফিয়া : ও জ্যোতিষীর গণনা। হাঃ হাঃ হাঃ
জোছনা-ভরা উঠানে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রা স্পষ্ট শুনল মহিশূরের মহাপরাক্রমশালী টিপু সুলতান হাসছেন। হাসির শব্দে চিত্রার শরীর ঝনঝন করতে লাগল। আর ঠিক তখনি স্কুলঘরের দিক থেকে হৈ চৈ এর শব্দ আসতে লাগল। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাচ্ছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিত্রা যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল।
মাহফুজ বিছানায় বসে আছে। সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে?
চিত্রা বলল, কিছু হয় নি। আপনার শরীর এখন কেমন?
মাহফুজ বলল, ভাল। চিৎকার কিসের?
চিত্রা বলল, আমি কি করে জানব কিসের চিৎকার। আপনার গ্রামের চিৎকার আপনি জানবেন।
.
সুলতান সাহেব ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন– ট্রেনে করে তিনি যাচ্ছেন। কামরায় তিনি এবং রানু। রানু জানালার পাশে বসে গল্পের বই পড়ছে। বইটা মজার। রানু একটু পর পর খিল-খিল করে হেসে উঠছে। তিনি বইটার নাম পড়তে চেষ্টা করছেন পারছেন না। রানু আড়াল করে রেখেছে। তিনি বললেন, বইটা উঁচু করে ধর তো মা। রানু কঠিন গলায় বলল, না। রানুর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তিন বিস্মিত। রাগ করার মত কথা তো বলেন নি। রানু এমন রাগ করছে কেন? এই সময় কিছু একটা ঘটল। ট্রেন থেমে গেল। ট্রেনের সমস্ত যাত্রিরা হৈ চৈ করতে শুরু করল। হৈ চৈ চিৎকার এবং কান্নাকাটি। তিনি জানালা দিয়ে গলা বের করে কি হয়েছে দেখতে চেষ্টা করছেন। শুধু তাদের কামরায় বাতি আছে। তাদের কামরা ছাড়া পুরো ট্রেন অন্ধকার। তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, রানু কি হয়েছে জানিস? রানু তাঁর কথার জবাব দিচ্ছে না। সে খিল-খিল করে হাসছে এই সময় তার ঘুম ভাঙল। তিনি দেখলেন সত্যি সত্যি হৈ চৈ হচ্ছে। চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ঘরে তিনি একা– রানু নেই। তিনি ডাকলেন- রমিজ রমিজ। কেউ সাড়া দিল না। সাড়া দেবার কথা না। রমিজ রানুকে নিয়ে নাটক দেখতে গিয়েছে। হৈ চৈ কি সেখানেই হচ্ছে?