কস কি?
বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নাই।
বিছানায় উঠে না বসলে চলবে কি ভাবে? তোমাদের মধ্যে একজন যাও। ডাক্তার নিয়ে আস। ডাক্তাররে বলবা যেভাবেই হোক সে যেন মাহফুজকে উঠে বসাবার ব্যবস্থা করে। আইজ রাইতে তাকে প্রয়োজন হবে।
ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরালেন। মুসলেম মিয়া চলে গেল। তাঁর মন বলছে কাজটা ঠিক হয় নাই। কাজটা ভুল হয়েছে। তার দলের সবাইকে আশে পাশে থাকা দরকার। রাতটা ভাল না।
ছদরুল বেপারী ক্লাবঘর থেকে বের হলেন। এখন শুক্লপক্ষ। আকাশে চাঁদের আলো আছে। আশ্বিনমাসের চাঁদের আলোয় অস্পষ্টতা থাকে। তবে আজকের আকাশ পরিষ্কার। কুয়াশাও নেই। চাঁদের আলোয় চারদিক দেখা যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্রামে ভয়ংকর ব্যাপারগুলো অমাবশ্যাতেও হয় না, আবার পূর্ণিমাতেও হয় না। এরকম সময়ে হয়। তাঁকে প্রথমবার খুন করার চেষ্টা করা হয় আশ্বিন মাসে। চাঁদের কত তারিখ তা মনে নাই। আকাশে চাঁদ ছিল এটা মনে আছে। তার পেট থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছেন চাঁদের দিকে। তার পরিষ্কার মনে আছে। ছদরুল বেপারীর সঙ্গীরা তার পেছনে পেছনে আসছে। তারা হাঁটছে খানিকটা দূরত্ব রেখে। একজনের গায়ে চাদর। তার বগলে কালো চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। এই খবরটাও নিশ্চয়ই এরমধ্যে কেউ কেউ জেনে গেছে। টাকার জন্যেও সমস্যা হতে পারে। এতগুলো টাকা কখনোই সঙ্গে রাখা উচিত না। কিন্তু ছদরুল বেপারী বেছে বেছে অনুচিত কাজগুলোই করেন। তার ভাল লাগে।
তিনি নিজের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। এই ধরণের উত্তেজনার মুখোমুখি হওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে।
কুদ্দুস!
কুদ্দুস তাঁর দিকে দৌড়ে এল। সামান্য পথ দৌড়েই সে হাঁপাচ্ছে। এই হাঁপানোটা কি ইচ্ছাকৃত?
পান খেতে ইচ্ছা করতেছে। কাঁচা-সুপারি দিয়া পান।
কুদ্দুস বিস্মিত হয়ে বলল, আমি যাব?
হ্যাঁ। তুমি যাবে। তোমার যেতে কোন অসুবিধা আছে?
দুএকটা আজেবাজে লোক ঘুরাফিরা করতেছে।
হু।
কানা রফিকরে দেখলাম। চাদ্দর দিয়া শইল ঢাইক্যা আসছে। তার সাথে লোকজন আছে।
টিপু সুলতান দেখতে আসছে। আমি যদি আসতে পারি তার আসতে দোষ কি? আমরা নাটক দেখব দুই চউখে। কানা রফিক দেখব এক চউখে।
মনে হয় আপনার দিকে নজর আছে।
থাকুক নজর। তোমাকে পান আনতে বলছি তুমি পান আন।
কুদ্দুস নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে রওনা হল। পিস্তলটা তার কাছে থাকে। বড় সাহেবের উচিত তাকেই সবসময় পাশে রাখা। কিন্তু তিনি তা করেন না। যে কোন কাজে তাকে পাঠিয়ে দেন। পান আনার মত তুচ্ছ কাজে যেতে তার খুবই খারাপ লাগছে।
ছদরুল বেপারী স্কুল ঘরের দিকে রওনা হলেন। তার পেছনে এখন শুধু একজনই আছে। সে কালো চামড়ার ব্যাগ বগলে নিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটছে। ছদরুল বেপারী হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। মৃদু গলায় বললেন, আমার পিছে পিছে আসার দরকার নাই তুমি ক্লাবঘরে থাক। একা একা হাঁটতে আমার ভাল লাগতাছে। মাঝেমধ্যে একা থাকা ভাল। চান্নিটাও উঠছে ভাল। বহুত দিন চান্নি দেখি না।
.
মাহফুজ ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে চিত্রার খুবই মায়া লাগছে। যদিও মায়া লাগার কিছু নেই। ছোট বাচ্চারা যখন কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঘুমায় তখন দেখতে ভাল লাগে। ছোট বাচ্চারা ঘুমের মধ্যেই হাসে। ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট বাঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গি করে। তাদের জন্যে মায়া হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষ ঘুমুচ্ছে তার জন্যে মায়া হবে কেন? চিত্রার হচ্ছে। শুধু যে হচ্ছে তাই না খুব বেশি হচ্ছে।
মানুষটা এতক্ষণ ছটফট করছিল। এখন সেই ছটফটানি নেই। কেমন শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার ঘুমের মধ্যে ছোট বাচ্চাদের মত ঠোঁট বাকাচ্ছে। মানুষটা ঘামছে। তার মানে জ্বর কমে যাচ্ছে। চিত্রা নিশ্চিত, কিছুক্ষণ আরাম করে ঘুমানোর পর মানুষটা সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে বসবে। গম্ভীর গলায় বলবে- চল প্লে শুরু করা যাক। তখন আর তার আগের কথা কিছু মনে থাকবে না।
মাহফুজের ব্যাপারটা চিত্রা পুরোপুরি ধরতে পারছে না। মানুষটার মাথায় রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ এই সব ঘুরছে কেন? নিজের কোন কাজ-কর্ম নেই বলে? চিত্রার মা বলতেন– কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম নেয় ভূতের কিল খাওনের জন্যে। সারাজীবন এরা ভূতের কিল খায়। ভূতের কিল কি জিনিস? ভূতের কিল হইল দশভূতের জন্যে কাম করা। নিজের জন্যে কাঁচকলা। এরা ভূতের কাম করবে। ভূতের কিল খাইবে। এইটাই এরার কপাল।
চিত্রার ধারণা এই মানুষটাও জন্মেছে ভূতের কিল খাবার জন্যে। তার খুব কাছের কেউ নেই যে তাকে বলে দেবে ভূতের কিল খাওয়াটা এমন জরুরি কিছু না। আগে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে তারপর ভূত- প্রেতের কিল খেতে চাইলে খাওয়া।
এই মানুষটার নিজের মনে হচ্ছে কিছুই নেই। ঘর-বাড়ির খুবই ভয়াবহ অবস্থা। তার নিজের ধানী জমির সবটাই সে স্কুল ফান্ডে দিয়েছে। তার যুক্তি আমি নিজে যদি না দেই, অন্যরা আমারে দিব কেন? ভূতের কিল খাওয়ার জন্যে যাদের জন্য তাদের জন্যে এই যুক্তি খুবই ভাল। কিন্তু চিত্রার কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। চিত্রা ঠিক করেছে চলে যাবার আগে সে মানুষটাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলে যাবে।
এক. আপনি একটা বিয়ে করুন। এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করুন যে আপনাকে দেখবে এবং আপনি দেখবেন আপনার গ্রাম, রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ।