মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তার পর তার ঘুম চলে যাবার কথা। কিন্তু ঘুম যাচ্ছে না। তাঁর মনে হল তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মানসিক ক্লান্তি ছড়িয়েছে শরীরে। তাঁর শরীর ক্লান্ত হচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু তাকে ঘুমুলে চলবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে।
বাবা তাকাও।
সুলতান সাহেব তাকালেন। রানু এবার হলুদ শাড়ি পরে এসেছে হলুদ শাড়ি লাল পাড়। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান কিংবা পহেলা ফাল্গুনে মেয়েরা এধরণের শাড়ি পরে।
কেমন লাগছে বাবা।
খুব সুন্দর লাগছে।
দশে কত দেবে?
সাড়ে আট।
সামান্য বাড়ানো যায় না?
না।
প্লিজ বাবা, নয় করে দাও।
রানু হাত জোড় করে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। মেয়েটা আজ বড়ই আনন্দে আছে। সুলতান সাহেবের বুকে হঠাৎ ধাক্কার মত লাগল। তার মেয়েটা অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায় সে ভয়াবহ কাণ্ড মাঝে মধ্যে করে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার মত ভয়ংকর কিছু। কাণ্ডটা যখন করে তার আগে আগে সে খুব আনন্দে থাকে। এবং চোখে পড়ার মত সাজগোজ করে।
রানু বলল, বাবা তুমি এমন ঝিম মেরে আছ কেন? কিছু বল।
মওলানা ইস্কান্দর
০৭.
মওলানা ইস্কান্দর শুয়ে আছেন। ঘর অন্ধকার। এশার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। এই সময় বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না। শরীর খারাপ থাকলে একটা কথা ছিল। তার শরীর খারাপ না। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। এটাও বড় কিছু না। যারা পাক কোরান মজিদ মুখস্থ করার চেষ্টা করে তাদের কারো কারো মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণার মত হয়। এই যন্ত্রণা কখনো যায় না। কখনো বাড়ে কখনো কমে। এখন এই যন্ত্রণা সামান্য বেড়েছে।
মওলানা উঠে বসলেন। বারান্দায় গিয়ে অজু করলেন। এশার আজান দেয়া দরকার। অবশ্যি আজান দিয়ে লাভ নেই। আজান হচ্ছে নামাজের জন্যে আহ্বান। মসজিদই নেই, নামাজের জন্যে আসবে কে? তাছাড়া গ্রামে আজ বিরাট উৎসব। শুধু এই গ্রামের না, আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন চলে এসেছে। টিপু সুলতান প্লে হবে। ভুজঙ্গ নামের একজন টিপু সুলতানের পাট করবেন। খুবই নামি লোক। তিনি না-কি মানুষকে জাদু করে ফেলেন। অভিনয় শুরু করলে মানুষ নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যায়। দুধের শিশু মায়ের কোল থেকে টপ করে পড়ে যায়, মা বুঝতে পারে না। মা হা করে তাকিয়ে থাকে ভুজঙ্গের দিকে।
ইস্কান্দর আলি এশার নামাজে দাঁড়ালেন। রুকুতে যাবার সয় হঠাৎ তাঁর মনে হল তিনি যদি ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখতে যান তাহলে আল্লাহপাক কি তার উপর খুব নারাজ হবেন? চিন্তাটা মনে আসতেই ইস্কান্দর লজ্জা এবং দুঃখে কুঁকড়ে গেলেন। ছিঃ ছিঃ কি ভয়ংকর কথা। এরকম একটা চিন্তা নামাজে দাঁড়িয়ে তার মনে এল? নামাজে দাঁড়ানো মানে আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়ানো। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কি করে ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখার কথা ভাবতে পারলেন? এক বালতি টাটকা দুধে এক ফোঁটা গো-মূত্র পড়লে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। সারাজীবনের সুকর্মও এক মুহূর্তের অসৎ চিন্তায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ইস্কান্দার আলির চোখে পানি এসে গেল। তিনি নামাজ শেষ করলেন। কিছুক্ষণ বারান্দায় চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর মন বলছে আল্লাহপাক এই অপরাধের জন্যে তাঁকে ক্ষমা করবেন না। কঠিন শাস্তি দেবেন। তিনি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে কোরাণ শরীফ নিয়ে বসলেন। চোখ বন্ধ করে তিনি কোরাণ পাঠ করবেন। রেলের উপর কোরাণ শরীফ থাকবে। কোথাও আটকে গেলে পাতা উল্টে দেখে নেবেন। তার ধারণা তিনি আটকে যাবেন। তাঁর মত নিচ প্রকৃতির মানুষকে আল্লাহপাক এত দয়া করেন না। যে দয়ার যোগ্য আল্লাহ পাক তাকেই দয়া করেন।
মওলানা ইস্কান্দার আলি কোরাণ পাঠ শুরু করলেন।
.
ছদরুল বেপারীর হঠাৎ মনে হল, কোথায় একটা সমস্যা হয়েছে। খুব ছোট্ট সমস্যা, তিলের মতই ছোট তবে এই ছোট্ট তিল তাল হয়ে উঠতে পারে। সেই সম্ভাবনা আছে। সমস্যাটা ছদরুল বেপারী ধরতে পারছেন না। কিন্তু অনুভব করতে পারছেন। কেউ তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। সেই কেউটা কে? মানুষের ভেতর কি আরো কোন মানুষ বাস করে? যার প্রধান কাজ সতর্ক করে দেয়া? তার উচিত এই মুহূর্তে এই অঞ্চল ছেড়ে নিজের নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া। সেটা করতেও ইচ্ছা করছে না। ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখে যেতে ইচ্ছা করছে। ছদরুল বেপারীর পাঞ্জাবীর পকেটে সোনার মেডেল। সোনার মেডেলটা তিনি নিজেই ভুজঙ্গ বাবুর গলায় পরিয়ে দেবেন।
রাত নটা বাজে। এগারটার আগে নাটক শুরু হবে না। এর মধ্যেই মানুষের সমুদ্র হয়ে গেছে। এখনো স্রোতের মত লোক আসছে। এই ছোট্ট গ্রামের কি এত মানুষের জায়গা দেবার মত অবস্থা আছে? বিশৃঙ্খলা শুরু হলে সামলাবার ব্যবস্থা কি আছে? অল্প কিছু মানুষের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সেই বিশৃঙ্খলা সামলানো যায়। যেখানে অসংখ্য মানুষ সেখানে বিশৃঙ্খলা ডালপালা ছড়াতে থাকে।
ছদরুল বেপারী তার সঙ্গীদের দিকে তাকালেন। সবাই আশেপাশেই আছে। শুধু একজন নেই। তাকে স্যাকরার দোকান থেকে আরেকটা মেডেল কিনতে পাঠানো হয়েছে। সেই মেডেলটা দেয়া হবে চিতা নামের মেয়েকে। না চিতা না চিত্রা। মেডেল নিয়ে এখনো ফিরছে না। ফিরলে ভাল হত। রাতটা ভাল মনে হচ্ছে না। আজ রাতে সবারই আশেপাশে থাকা দরকার।
ছদরুল বেপারী বললেন, মাহফুজ কই। মাহফুজকে ডেকে আন। তারে দুটা কথা বলব। তারে কিছু পরামর্শ দিব। ছদরুলের এক সঙ্গি মুসলেম মিয়া কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, উনার শরীর খুবই খারাপ। বাড়িতে শুয়ে আছেন। মাথায় পানি ঢালা হইতেছে।