ছদরুল বেপারী ঘর থেকেই বের হয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বাগানে একটা পরী হাঁটছে। পরী তো অবশ্যই। পৃথিবীর কোন মেয়ে এত সুন্দর হতে পারে না। নিশ্চয়ই সুলতান সাহেবের মেয়ে। সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। সবুজ গাছপালার ভেতর সুবজ রঙের শাড়ি। বাগানের সঙ্গে মেয়েটার মিশে যাবার কথা। মিশে যায় নি। মনে হচ্ছে সমস্ত বাগান এক দিকে আর মেয়েটি অন্যদিকে। ছদরুল বেপারীর চোখ চকচক করছে। মেয়েটা নিজের মনে হাঁটছে। ছদরুল বেপারীর দিকে তাকাচ্ছে না। এটা ভাল। চোখে চোখ পড়লে ছদরুল বেপারীকে চলে যেতে হবে। চোখ না পড়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকায় কোন দোষ নেই।
.
সুলতান সাহেব ইজিচেয়ার টেনে জানালার কাছে নিয়ে এলেন। তাঁর মন পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত। তারপরেও কেন জানি ঘুম ঘুম পাচ্ছে। অভ্যস্ত জীবন যাত্রা থেকে সরে এলে সিস্টেমে গণ্ডগোল হয়ে যায়। যখন ঘুম পাবার কথা না, তখন ঘুম পায়। ঘুমের সময় বিছানায় বসে থাকতে হয়।
আয়োজন করে ঘুমুতে গেলে ঘুম হবে না। তিনি বেশ আয়োজন করেই ইজিচেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। মাথার নিচে বালিশ। হাত-পা ছড়ানো। আয়োজন দেখেই ঘুমের পালিয়ে যাবার কথা।
বাবা, আমার দিকে একটু তাকিয়ে দেখ তো!
সুলতান সাহেব চোখ মেললেন। রানু তার সামনে দাঁড়িয়ে। রানুর মুখ হাসিহাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার জীবন স্বচ্ছ এবং আনন্দময়। বাবার সঙ্গে কথা বলেও সে তৃপ্তি পাচ্ছে।
আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বাবা?
খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। সবুজ শাড়ি পরার জন্যে বন-পরী লাগছে।
বন-পরী আবার তুমি কোথায় পেলে? জল-পরী আছে। বন-পরী বলে কিছু নেই।
গ্রীক মিথলজীতে বন-পরী আছে। এরা একগাছ থেকে আরেক গাছে। উড়ে উড়ে বেড়ায়। এদের স্বভাবও খানিকটা উগ্র।
উগ্র স্বভাবের বন-পরী হয়ে লাভ নেই। আমাকে খুবই সুন্দর লাগছে। কি-না সেটা বল।
যে সুন্দর তাকে সবসময় সুন্দর লাগে। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে বের হলেও তাকে দেখে মনে হবে– ছেঁড়া কাঁথাতে তার সৌন্দর্য ফুটেছে।
দশের মধ্যে তুমি আমাকে কত দেবে?
দশে সাড়ে আট।
আমি কিছুক্ষণ পর অন্য একটা শাড়ি পরে আসব। তখনো তুমি নাম্বার দেবে। তিনটা শাড়ি পরব। এর মধ্যে যে শাড়িটায় আমাকে সবচে সুন্দর লাগবে সেইটা পরে নাটক দেখতে যাব।
তিনটায় যদি একই রকম ভাল লাগে তখন কি করবি?
তখন টস করব। বাবা শোন, তুমি তো যাচ্ছ না, তাই না?
না, যাচ্ছি না।
আমি রমিজ ভাইকে নিয়ে যাব। তুমি কোন দুঃশ্চিন্তা করবে না।
আমি দুঃশ্চিন্তা করছি না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমে তোমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ, ঘুমুবে না। তুমি হচ্ছ বিউটি কনটেস্টের বিচারক।
তোকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?
নকল খুশি বাবা। চিত্রা অভিনয় করে স্টেজে অনেক দর্শকের সামনে। আমি করি বাড়িতে। আমার দর্শক একজন- তুমি।
সুলতান সাহেব শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে বললেন, একটা কথার জবাব দিয়ে যা, তুই কি আমাকে খুবই অপছন্দ করিস।
রানু বলল, হ্যাঁ।
কেন?
একবার তো বলেছি কেন।
আমার মধ্যে প্রচুর ভান এই জন্যে?
হ্যাঁ। তোমাকে আমার নকল মানুষ মনে হয়।
আধুনিক শিক্ষিত মানুষ মাত্রই নকল মানুষ। বোস আমার সামনে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি।
বক্তৃতা শুনতে একদম ইচ্ছা করছে না।
বক্তৃতা না। আসল মানুষ, নকল মানুষ ব্যাপারটা শুধু ব্যাখ্যা করব। দুমিনিটের বেশি লাগবে না।
রানু বাবার ডানপাশের খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। সে পা নাচাচ্ছে। সুলতান সাহেব লক্ষ্য করলেন, রানু পায়ে আলতা দিয়েছে। আলতা দেয়া ভাল হয় নি। রঙ লেপ্টে গেছে। তারপরেও সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে আলতা এভাবেই দিতে হয়। সুলতান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন– মনে করা যাক খনি থেকে একখণ্ড হীরক পাওয়া গেল। এই হীরাটাকে আমরা বলব আসল। কারণ হীরাটা আছে Crude ফর্মে। সেই হীরা পলিশ করা হল। হীরা কাটা হল। অর্থাৎ Crude হীরা আধুনিক হল। তুই আধুনিক হীরাকে বললি নকল।
রানু বলল, তোমার যুক্তি আমার কাছে খুবই এলোমেলো মনে হচ্ছে। হীরাকে পলিশ করলে বা কাটলে যা থাকে তাও হীরা। আগে আসল পরেও আসল। এক টুকরা কাঁচ যদি দেখতে হীরার মত হয় সেটা হল নকল।
হ্যাঁ।
তোর মার সঙ্গে আমার বনিবনা হয় নি এই কারণে আমি নকল?
উল্টো। মাকে তো আমি নকল বলছি না। বনিবনা তো মারও তোমার সঙ্গে হয় নি। মাকে আসল বলছি।
নকল হলেও তোমার আলো খুবই প্রবল। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এই জন্যে আমি ঠিক করেছি তোমার সঙ্গে থাকব না।
সুলতান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, কোথায় যাবি?
কোথায় যাব এখনো ঠিক করি নি। তবে মার কাছে গিয়ে মাকে বিব্রত করব না। হুট করে কোন এক জায়গায় চলে যাব। আসল কোন মানুষকে গিয়ে বলব– আমাকে আশ্রয় দিন।
আসল-নকল চিনবি কিভাবে তোর কাছে কষ্টিপাথর আছে?
হ্যাঁ আছে।
তুই কি জানিস তুই অসুস্থ? খুবই অসুস্থ।
যে অসুস্থ তার কাছেই সুস্থ মানুষকে অসুস্থ মনে হয়।
তোর ধারণা আমি অসুস্থ?
হ্যাঁ।
এবং তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
হ্যাঁ।
সেই ঘটনাটা কবে ঘটবে?
যে কোনদিন ঘটতে পারে। আজও ঘটতে পারে।
সুলতান সাহেব তাকিয়ে আছেন। রানু উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, বাবা এখন যাই। অন্য একটা শাড়ি পরে আসি। মনে রাখবে সবুজ শাড়িতে তুমি আমাকে দিয়েছ সাড়ে আট। সুলতান সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।