তাঁর শরীর ভালই আছে। মনটা ভাল নেই। শরীর মনের ওজন বহন করে। কোন কারণে মন ভারী হলে শরীরের সেই ওজন বহন করতে কষ্ট হয়। এই কষ্টটা তার এখন হচ্ছে। রানু তার মন খারাপ করে দিয়েছে। তাঁর সম্পর্কে রানুর ধারণা যে এতটা খারাপ তিনি বুঝতে পারেন নি। তাঁর বোঝা উচিত ছিল। রানু তাকে বুঝতে দেয় নি। এই বিষয়েও রানুর সঙ্গে কথা বলা দরকার। সেই কথাগুলো গুছিয়ে নেবার জন্যেও সময় লাগবে।
প্রিয়জনদের সঙ্গে মানুষ সব সময় কঠিন যুদ্ধ করে। আদর্শের যুদ্ধ। পছন্দ অপছন্দের যুদ্ধ। মানসিকতার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ মধ্যযুগের তলোয়ার বশীর যুদ্ধের চেয়ে কম ভয়াবহ যুদ্ধ না। সেই যুদ্ধেও আহত হবার মত ব্যাপার ঘটে। রক্তক্ষরণ হয়। যে কোন যুদ্ধে প্রস্তুতি লাগে। অস্ত্র শানিয়ে নিতে হয়। তূণে ধারালো তীর জমা করতে হয়। তাঁকে এই কাজটা করতে হবে। যুদ্ধে নেমে যেন অস্ত্রের অভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে না হয়। এমন এক জটিল সময়ে ছদরুল বেপারীর সঙ্গে কেমন আছেন, ভাল আছি টাইপ কথা বলা সম্ভব না।
সুলতান সাহেব রমিজকে বললেন, আমার সঙ্গে যিনি দেখা করতে এসেছেন তাঁকে গিয়ে বল আমি এখন পড়াশোনা করছি। তিনি যেন পরে আসেন। তাঁর সঙ্গে পরে কথা বলব।
রমিজ অবাক হয়ে বলল, চলে যেতে বলব?
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, হ্যাঁ চলে যেতে বলবে। তবে খুব ভদ্রভাবে বলবে।
রমিজ ইতঃস্তত করে বলল, ছদরুল বেপারী খুবই বিশিষ্ট লোক।
যত বিশিষ্টই হোক আমি এখন নিচে নামব না।
সুলতান সাহেব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন রমিজ দাঁড়িয়ে আছে যেতে চাচ্ছে না। রমিজকে প্রচণ্ড ধমক দেয়া উচিত। তিনি ধমক দিলেন না। সহজ গলায় বললেন, ঠিক আছে উনাকে বসতে বল, আমি আসছি। আর দুকাপ চা দাও। ঘরে কোন খাবার থাকলে দাও।
রমিজের মুখে হাসি দেখা গেল। মনে হল সে বিরাট বিপদের হাত থেকে অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছে। ছদরুল বেপারীর মত বিশিষ্ট লোককে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
সুলতান সাহেবকে দেখে ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়াল। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার আমি খুবই শরমিন্দা যে আপনারে বিরক্ত করতেছি। বিশ্রাম করতেছিলেন।
কোন অসুবিধা নেই। বসুন।
আপনাকে দেখার বড়ই শখ ছিল। শখ মিটানোর জন্যে এসেছি।
শখ মিটেছে?
জ্বি মিটেছে। আমার মনে যখন যে শখ উঠে শখ মিটায়ে ফেলার চেষ্টা করি। মওলানা ইস্কান্দর সাহেবকে দেখনের শখ ছিল, দেখলাম। আপনেরে দেখনের শখ ছিল, দেখলাম। লোকজন তাজমহল দেখতে যায়, সমুদ্র দেখতে যায়। আমি যাই মানুষ দেখতে। আসল মজা মানুষের মধ্যে। সুলতান সাহেব লোকটির কথা বলার কায়দায় অবাক হলেন অশিক্ষিত মানুষ এমন গুছিয়ে কথা বলে না। সুলতান সাহেব বললেন, আপনার প্রধান কাজ তাহলে মানুষ দেখে বেড়ানো?
ছদরুল বেপারী সঙ্গে সঙ্গে বলল, জ্বি না। এটা আমার শখ। কোন মানুষ সম্পর্কে যখন বিশেষ কিছু শুনি তখন মানুষটারে দেখতে ইচ্ছা করে।
আমার সম্পর্কে বিশেষ কি শুনেছেন?
অনেক কিছু শুনেছি জনাব। আপনি একটা বই লিখেছেন। সেই বই সংগ্রহ করে পড়েছি। অত্যন্ত তৃপ্তি পেয়েছি। কিছু অতি সত্য কথা বলেছেন।
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে গেল। একটি বই তিনি ঠিকই লিখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই। নাম The End game ইংরেজীতে লেখা এই বই সামনে বসে থাকা লুঙ্গি ফতোয়া পরা মানুষটা পড়েছে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। বই ছাপা হয়েছে মোট এক হাজার কপি। এই বই সংগ্রহ করাই মুশকিল।
আপনি আমার বইটা পড়েছেন?
জ্বি জনাব।
বইটা ইংরেজীতে লেখা।
জ্বি জনাব। আমার সেক্রেটারীকে বলেছি সে বাংলা করে আমকে শুনায়েছে।
বই এর কোন জায়গাটা আপনার ভাল লেগেছে?
ছদরুল বেপারীর হাসি মুখে বলল, আপনার বোধ হয় মনে সন্দেহ হয়েছে বইটা আমি পড়ি নাই। আপনার সঙ্গে দেখা করব ঠিক করার পর আপনার সম্পর্কে জানার জন্যে বইটা ঢাকা থেকে এনে পড়ার ব্যবস্থা করেছি। বইয়ের কোন জায়গাটা ভাল লেগেছে জানতে চেয়েছেন- নামটা ভাল লেগেছে। নাম দিয়েছেন শেষ খেলা অথচ বইটাতে বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার কথা। এইটা ভাল হয়েছে। জনাব যদি ইজাজত দেন তাহলে উঠি?
এখন উঠবেন কেন? চা খান।
জ্বি না, চা খাব না। জনাব উঠি।
ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়াল।
সুলতান সাহেব বললেন, বসুন বসুন। এসেই চলে যাচ্ছেন। আপনি যেমন আমার ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করছেন। আমিও করছি। আপনি একজন বিশিষ্ট মানুষ।
জনাব, আমি মাটির কৃমি। বিশিষ্ট কিছু না। তারপরও যদি আমার। বিষয়ে কিছু জানতে চান বলেন।
নামের শেষে বেপারী যুক্ত করেছেন কেন?
ছদরুল বেপারী বসলেন না, দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন, নিজে কিছু যুক্ত করি নাই। লোকের মুখে মুখে বেপারী হয়েছি। আমি এতেই খুশি। লোকজন ইচ্ছা করলে আমারে ছদরুল-চোরা বলতে পারত। ছোটবেলায় চুরি-চামারি করতাম। আমার ভাগ্য কেউ চোর বলে না।
এখানকার স্কুল ফান্ডে আপনি ডোনেশন দিচ্ছেন বলে শুনতে পাচ্ছি।
জ্বি দিচ্ছি। টাকা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আমি আবার নগদ কারবারে বিশ্বাস করি।
সুলতান সাহেব জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন দানের পরিমানটা কত। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন। এমন অরুচিকর একটা প্রশ্ন যে তাঁর মনে এসেছে। এজন্যেও তাঁর লজ্জা লাগছে।
ছদরুল বেপারী গলা খাকারি দিয়ে বললেন, স্যারের মনে হয় জানার ইচ্ছা কতটাকা দিতেছি। প্রথম দফায় দশ লাখ টাকা। এটা ছাড়া মসজিদটা করে দিব। পুরানা মসজিদটা ভেঙে পড়ে গেল। মনটা খারাপ হয়েছে। আমি নিজে নামাজ পড়ি না তাতে কি অন্য দশজন তো পড়ে। জনাব যাই। অনেক বিরক্ত করেছি। যাবার আগে আরেকটা কথা বলে যাই বেয়াদবী মাফ করে দেবেন। আপনি যে বইটা লিখেছেন তার নামটাই শুধু ভাল হয়েছে। বইটা ভাল হয় নাই।