চিত্রার মা তখন অতি বিরক্ত হয়ে বলতেন– এর সাথে কথা কইলেও পাপ হয়। বিরাট পাপ।
তোমাকে কি কথা বলার জন্য পা ধরে সাধি? কথা না বললেই হয়। মেয়ের সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া চিত্রার মা কথা বলতেন না। দুজন মানুষ পাশাপাশি বাস করছে, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না।
মাহফুজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। কি ভয়ংকর নির্জন বাড়ি। গ্রামের বাড়ি কখনো এমন নির্জন হয় না। কেউ না কেউ সারাক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে। আজ কেউ নেই। সবাই জড় হয়েছে প্রাইমারী স্কুলের ময়দানে, কিংবা ক্লাবঘরের আশেপাশে। কাউকে পেলে ভাল হত। তাকে ডাক্তারের খোঁজে পাঠানো যেত। এই গ্রামে ডাক্তার থাকেন বলে চিত্রার মনে হয় না। তবে দুবছর পর থাকবে। ডাক্তার থাকবে, হাসপাতাল থাকবে, পাকা রাস্তা থাকবে। রোগীর খবর পেলে সাইকেল বিক্সায় টং টং করতে করতে পাকা রাস্তায় ডাক্তার চলে আসবে।
মাহফুজ পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, দাদীজান পানি খাব। চিত্রা পানি আনার জন্যে উঠে দাঁড়াল। একটা ব্যাপারে চিত্রা খুবই আশ্চর্যবোধ করছে। মানুষটা অসুস্থ হলেই বিড়বিড় করে তার দাদীজানের সঙ্গে কথা বলে।
নিন পানি এসেছি।
মাহফুজ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই সে মুখ হা করল। চিত্রা বলল, এই ভাবে তো পানি খেতে পারবেন না। আপনাকে উঠে বসতে হবে। উঠে বসতে পারবেন?
মাহফুজ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। গ্লাস হাতে নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে পানি খেয়ে খাট থেকে নামতে গেল। চিত্রা তাকে ধরে ফেলে বলল, কোথায় যাচ্ছেন?
ক্লাবঘরে যাব।
এই অবস্থায় ক্লাবঘরে যাবেন মানে?
তোমাকে তোমার মার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঝামেলা হয়ে গেছে। বিরাট ঝামেলা। নাটক বন্ধ। এখনই তোমাকে পাঠিয়ে দিব।
ঘটনা কি বলুন তো?
ঘটনা কিছু না তোমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।
কে আমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে?
আমার দাদীজান।
চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আপনি আমার কথা শুনুন। জ্বরে আপনার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনি কি বলছেন না বলছেন নিজেই জানেন না।
মাহফুজ ক্লান্ত গলায় বলল, এখন তোমাকে পাঠায়ে না দিলে বিরাট ঝামেলা হবে। ছদরুল বেপারীকে তুমি চেন না। ভয়ংকর মানুষ। নাটকের শেষে সে তোমাকে নিয়ে যাবে।
চিত্রা বলল, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না।
তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না।
বুঝতে পারব না কেন? এটা তো নতুন কোনো ঝামেলা না। পুরনো ঝামেলা। নাটকের মেয়ে মফঃস্বলে নাটক করতে গিয়েছে আর মফঃস্বলের ক্ষমতাবান মানুষদের কেউ মেয়েটার সঙ্গে রাত কাটাতে চায় নাই এটা তো এখনো হয় নাই।
ও
আমার জন্যে এটা নতুন কিছু না।
ও
এসব আমাদের হিসাবের মধ্যে ধরা থাকে।
ও
আমার মা ছিলেন খারাপপাড়ার খারাপ মেয়ে। আমি নিজেও সেই জিনিস। আপনার এত চিন্তা কি জন্যে? শুয়ে থাকেন।
মাহফুজ শুয়ে পড়ল।
চিত্রা নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছে। মাহফুজ কথাগুলো শুনছে কি শুনছে না তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।
আপনে যখন ছিলেন না তখন ছদরুল বেপারীর লোক আমার কাছে এসেছিল। তার সাথে কথা হয়েছে। এক রাতের জন্যে আমি পাব দশ এই হাজার টাকা। বুঝেছেন। এই টাকাটা আমার দরকার। আমার মার দরকার।
মাহফুজ তাকিয়ে আছে। তার মাথার তীব্র যন্ত্রণা কমে আসছে। মাথার ভেতর বসে থাকা দাদীজান মনে হয় পান খেয়ে খেয়ে এখন ক্লান্ত। কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমুতে যাবে।
আবু ও আবু!
মাহফুজ চমকে গেল। বুড়ি এখনো ঘুমায় নি। জেগে আছে।
আবুরে শোন।
শুনতেছি।
মেয়েটা মিথ্যা কথা বলতেছে। যা বলতেছে সবই মিথ্যা।
আইচ্ছা।
দুঃখ ধান্ধায় বড় হইছে তো। নানান সময়ে মিথ্যা বলতে হইছে।
আইচ্ছা ঠিক আছে।
তুই মন খারাপ করিস না।
আরে কি যন্ত্রণা, আমি মন খারাপ করব ক্যান?
মাহফুজের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। মেয়েটা শুধু যে পান ঢালছে তা না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা মাহফুজের এখন নেই কিন্তু তার কাছে সবকিছুই কেমন এলোমেলো লাগছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাথা অসম্ভব খালি খালি লাগছে। এরচে বুড়ি যদি পান ছেচতো ভাল লাগতো।
সুলতান সাহেব
০৬.
সুলতান সাহেব খুবই বিরক্তিবোধ করছেন। তিনি গ্রামের বাড়িতে এসেছেন বলেই যখন তখন যে কেউ তার ঘরে ঢুকে পড়বে তা মেনে নিতে পারছেন না। আবার কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি বলবেন- এখন দেখা হবে না। পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে। সেটাও তার কাছে। গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। গ্রামে তিনি সহজ সাধারণ একজন হিসেবে থাকতে চান। এমন একজন যার কাছে যে কেউ যে কোন সময় আসতে পারে A man has many faces. তার গ্রামের যে ছবি তা তাঁর কর্মজীবনের ছবির মত হবে না। কিন্তু তা বোধহয় হবার নয়। মানুষের খুব সম্ভব একটা Face ই থাকে।
তাঁর কাছে এই মুহূর্তে একজন দেখা করতে এসেছে। দর্শনপ্রার্থীরা নাম ছদরুল বেপারী। বেপারী কারো নাম হতে পারে না। ব্যবসা করলেই নামের শেষে বেপারী যুক্ত করার নিয়ম থাকলে তার নিজের নাম হত সুলতান অ্যাম্বেসেডর। লোকটার টাকা পয়সা আছে বলে সবাই তাকে তোয়াজ করছে। সেও নিশ্চয়ই তোয়াজ পেয়ে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ধরেই নিয়েছে সে যখন ইচ্ছা, যার সঙ্গে ইচ্ছা, দেখা করতে পারে। এ ধারণা ভেঙ্গে দেয়া দরকার। তিনি ঠিক করলেন রমিজকে বলবেন- আজ তিনি দেখা করবেন না। তার শরীর ভাল নেই।